পদ্মার ইলিশ। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। নাম শুনলেই জিবে জল আসে। সারাবিশ্বেই এর খ্যাতি। কিন্তু রুপালি এই ইলিশ সারা বছর ধরা পড়ে না। এরজন্য মৌসুম ঠিক করা আছে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষায়। এ সময় সাগর থেকে ঝাঁকেঝাঁকে ইলিশ নদীতে ছুটে আসে।
বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনা নদীর বিভিন্ন এলাকাকে ইলিশের অভয়ারণ্য মনে করা হয়। এই ইলিশ রক্ষায় সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। মা ইলিশ ও জাটকা বা ছোট ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও শত শত কোটি টাকার নিষিদ্ধ ইলিশই বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ইলিশ ধরা নিয়ন্ত্রণেও সরকারের বিধিনিষেধ আছে। এ ধরনের পদক্ষেপে গত কয়েক বছর ধরে ইলিশ ধরা পড়েছে প্রচুর। গত বছরও রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। ইলিশ নেই। জেলেরা দিনরাত চেষ্টা করেও জালে ইলিশ তুলতে পারছেন না। যা ধরা পড়ছে তা তাৎক্ষণিক বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে।
কেন এই আকাল। এতে আর্থিক ক্ষতি কেমন এ নিয়ে ইলিশের এলাকা হিসেবে খ্যাত জেলাগুলোর প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি তৈরিতে স্থানীয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করেছেন আমাদের বরিশাল ব্যুরো আকতার ফারুক শাহিন, ভোলা প্রতিনিধি অমিতাভ অপু, চাঁদপুর প্রতিনিধি মির্জ্জা জাকির এবং পটুয়াখালী প্রতিনিধি মো. জাফর খান।
ইলিশের দেশে ইলিশ নেই। এখন ভরা মৌসুমে দেশে ইলিশ মিলছে না। সামান্য কিছু ইলিশ ধরা পড়লেও তাতে মুনাফা দূরের কথা খরচের টাকাই আসছে না। ফলে জেলেদের মাথায় হাত। শূন্য হাতেই ফিরছেন বাড়ি। মাছের জন্য প্রায় প্রতিদিনই চলছে বিশেষ দোয়া-মোনাজাত। এতে একদিকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। পাশাপাশি ক্রেতাদেরও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ইলিশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় সরকারের নীতিতে বড় ধরনের ভুল রয়েছে। আর নীতিতে পরিবর্তন না এলে আগামীতে বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়। এর ৬০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। ফলে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১১ শতাংশ। সার্বিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় জিডিপিতে এর হিস্যা ১ শতাংশের সমপরিমাণ। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ইলিশের উৎপাদন তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে ওঠানামা করছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টনের মতো। এই হিসাবে প্রচলিত বাজারমূল্যে প্রতিকেজির গড় দাম কম করে ৬৫০ টাকা ধরা হলেও সংগৃহিত সাড়ে তিন লাখ টন ইলিশের সার্বিক বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এই হিসাবে চলতি মৌসুমে ৭০-৭৫ ভাগ মা ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ায় এর বাজার মূল্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, ইলিশের এই সম্ভাবনা এখন সুদূরপরাহত হতে চলেছে। কারণ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ইলিশের অভয়ারণ্যগুলোতে মৎস্য শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর সময়সীমা নির্ধারণ করায় ইলিশ আহরণের ক্ষেত্রে এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি ডেকে এনেছে। তাদের মতে, আরও বেশ কিছু দিন এসব মা ইলিশ অভয়ারণ্যগুলোতে ডিম ছাড়ার সময় পেলে একদিকে পরিপক্ব ইলিশের সংখ্যা যেমন বাড়ত, তেমনি অভয়ারণ্যগুলোয়ও এর বংশের বিস্তার ঘটত।
চাঁদপুর : ইলিশের রাজধানী খ্যাত চাঁদপুর মাছ ঘাটে হাঁকডাক নেই। গত বছরও এ সময় শত শত জেলে নৌকা ভিড়াত চাঁদপুর ঘাটে। এখান থেকে ট্রেনে, ট্রাকে সারা দেশে ইলিশ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এবার চিত্র ভিন্ন। চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনায় জেলেদের জালে ইলিশ খুবই কম ধরা পড়ছে। অথচ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতি বছরই দেশে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। চাঁদপুরে গত বছর ২০ হাজার ৪শ’ মে. টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ২শ’ কোটি টাকার উপরে। যা বিগত ৫ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ বলে তিনি দাবি করেন।
অভায়াশ্রম চলাকালীন জাটকা ও টেম্পু ইলিশ ব্যাপকহারে নিধন হওয়ায় ইলিশের উৎপাদন কম হচ্ছে বলে মনে করেন চাঁদপুর মাছ ঘাট ব্যবসায়ীসহ জেলেরা। এছাড়া নদীতে অসংখ্য ডুবোচর জেগে ওঠা, পানি দূষণের কারণকেও ইলিশের গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার জন্য দায়ী বলে তারা মনে করেন।
ইলিশের পাইকারি বড় মোকাম হচ্ছে চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছ ঘাট। সেই ঘাটে গিয়ে দেখা যায় মাছের তেমন আমদানি নেই। সারা ঘাটে ২-৩শ’ মণ ইলিশ আসছে। অথচ আগে এ ঘাটে একেকটি মোকাম ঘরে শত শত মণ ইলিশ আসত। বর্তমানে প্রতিদিন ১০-১২টি ছোট ট্রলার ও নৌকাযোগে যে ইলিশ চাঁদপুর মাছ ঘাটে আসছে তার বেশিরভাগ মাছ দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, ভোলা, চরফ্যাশন এলাকার নদীতে ধরা মাছ যা ‘নামার’ মাছ হিসেবে পরিচিত।
চাঁদপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান কালু ভূইয়া জানান, অভায়াশ্রম চলাকালীন জাটকা মৌসুমে জাটকা সঠিকভাবে রক্ষা না করায় ইলিশ উৎপাদন কম হচ্ছে। এছাড়া নদী দূষণ, আবহাওয়াজনিত সমস্যা ও ডুবোচরের কারণে গভীর পানির মাছ ইলিশ গত ক’বছর ধরে পরিপূর্ণ সাইজ হচ্ছে না। অর্থাৎ কেজি সাইজের উপরে ইলিশের উৎপাদন খুবই কম হচ্ছে।
বরিশাল : বরিশালে প্রায় শূন্য হাতে ফিরছে জেলেরা। লোকসান দিচ্ছে শত শত বরফকল। আড়তগুলোতেও যেন নিস্তব্ধতা। ইলিশের আকালে মাছনির্ভর দক্ষিণের অর্থনীতির দুরাবস্থা চলছে। হুমকির মধ্যে ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। মাছের জন্য প্রায় প্রতিদিনই চলছে বিশেষ দোয়া-মোনাজাত।
বরগুনা জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম জানান, ‘মাছ না থাকায় শোধ হয়নি মহাজনের দাদন। তারাও মাছের আশায় দিয়ে রেখেছেন সবকিছু। এই অবস্থায় আর টাকার জন্য যাওয়া যাচ্ছে না তাদের কাছে। ঘাড় ফেরানোর অবস্থাও নেই আমাদের।
পাথরঘাটা বিএফডিসি’র কর্মকর্তারা জানান, ‘গত বছর ১৫ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত এখানকার পাইকারি বাজারে ১ কোটি ১৬ লাখ ৭৪ হাজার টাকার মাছ কেনা-বেচা হয়েছে। কিন্তু এবছর একই সময়ে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ২শ’ টাকার মাছ।
পাথরঘাটা বরফকল মালিক সমিতির সভাপতি বাবুল খান বলেন, ‘মাছ না পড়ায় সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় আছে বরফকল মালিকরা। বিক্রি হোক আর নাই হোক ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা মেশিন চালাতে হচ্ছে আমাদের। এতে করে বিদ্যুৎ বিলসহ মোট ব্যয় হচ্ছে কলপ্রতি প্রায় ১২ হাজার টাকা। এর বিপরীতে গত ৩ দিনে মাত্র ১১ হাজার টাকার বরফ বিক্রি করেছে আমার কল।
ভোলা : জাতীয়ভাবে ৩৩ ভাগ ইলিশ মাছের চাহিদা পূরণ হয় এই জেলা থেকে। এবার শাহবাজপুর চ্যানেলসহ মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ছে না । দু’চারটি যা ধরা পড়ছে, তা অঙ্কের হিসাবে আসছে না। জেলা মৎস্য কর্মকর্তরা অবশ্য জানান, আশার কথা। এখন ইলিশ ধরা না পড়লেও অসময়ে কিছু ইলিশ ধরা পড়তে পারে বলেও মনে করেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম। এদিকে নদীতে ইলিশ না থাকায় বছরে এক লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরণের কথা থাকলেও এ বছর ১০ ভাগও অর্জিত হয়নি।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালী উপকূলের বঙ্গোপসাগর ও নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে না। ফলে চরম হতাশ হয়ে পড়েছে জেলেরা। সাগরে আসা-যাওয়ার খরচ পর্যন্ত উঠছে না। দাদনের টাকা আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে তারা। মহিপুর, আলিপুর ও রাঙ্গাবালীর স্থানীয় জেলেরা জানান, জুলাই থেকে অক্টোবর মাস ইলিশ ধরার মৌসুম। এখন জুলাই মাস শেষ হয়ে আগস্টের শুরু হলেও জালে কাক্সিক্ষত ইলিশ ধরা পড়ছে না। অথচ গত বছর এই সময়ে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছে। এখন তিন-চার দিন সাগরে কাটিয়ে যা ইলিশ ধরা পড়ছে, তাতে আসা-যাওয়ার খরচের টাকা উঠছে না। অনেকে দাদন ও ঋণের টাকা নিয়ে সাগরে গেছেন। তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। সুদ বাড়ছে, কিন্তু আয় নেই। তবে একেবারেই ইলিশের ‘খরা’ চলছে তেমনটাও বহু জেলে মনে করছেন না। মাঝেমধ্যে ঝাঁকেঝাঁকে ইলিশও ধরা পড়ছে, তবে তা বিশেষ দুই-তিন দিনে। ‘জো’-এর সময়টাতে কিছু মাছ ধরা পড়ছে।