আজ : ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News

চট্টগ্রামে জাল দলিলে জমি বিক্রির হিড়িক

চট্টগ্রামে জমির জাল দলিল তৈরিতে সক্রিয় একটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে বা কাউকে ভুয়া মালিক সাজিয়ে অন্যের জমি বিক্রি করে দিচ্ছে তারা। অথবা নিজেরাই বনে যাচ্ছে জমির মালিক। খোদ সাবরেজিস্ট্রি অফিস যে জমিতে সেই জমিও ভুয়া দলিলে বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। দলিল লেখক থেকে শুরু করে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের পিয়নসহ অনেকেই এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। এর ফলে জমির প্রকৃত মালিকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।

জানা যায়, ৩৯ বছর আগে মারা যান ছুরুত জামাল নামে এক ব্যক্তি। তাকেই জীবিত দেখিয়ে জাল দলিল তৈরির অভিযোগে ৩০ অক্টোবর মামলা করেন পটিয়ার কোলাগাঁও এলাকার আবু ছৈয়দ। মামলায় একই উপজেলার আবদুছ ছবুর, আবু বক্কর, এনামুল হক ও মাহাবুবুল আলমের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পটিয়া সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) দায়িত্ব দেন।

এজাহার সূত্রে জানা যায়, পটিয়ার নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ১৯৭৫ সালে তার ছেলে মুহাম্মদ ফোরকান ও মেয়ে ছুরুত জামালকে ৮০ শতক জায়গা দানপত্রমূলে দলিল করে দেন। ১৯৭৭ সালে ছুরুত জামাল মারা যান। এরপর তার ওয়ারিশরা ওই জায়গায় ভোগদখলে আছেন। ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর আবদুছ ছবুর ও আবু বক্কর নামে দুই ব্যক্তি ওই ৮০ শতক জায়গা থেকে ০.৭২৫ শতাংশ নাল জমি ও পুকুর ক্রয় করেন। দাতা হিসেবে ৩৯ বছর আগে মারা যাওয়া ছুরুত জামালের স্বাক্ষরেই এই জমি রেজিস্ট্রি হয় পটিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। দলিলে এনামুল হক ও মাহাবুবুল আলম নামে দু’জনকে সাক্ষী রাখা হয়। ২৩ অক্টোবর জমি দখল নিতে গেলে প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। বাদী আবু ছৈয়দ জানান, ভুয়া দলিল তৈরিতে ছুরুত জামালের নামে জাতীয় পরিচয়পত্র নং- ১৫১১২৭৬৪৫৪৩১৩, জন্ম তারিখ-২৬/০৫/১৯৭৫ ব্যবহার করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পটিয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহামুদ উল্লাহ মারুফ যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্তের জন্য এখনও কোনো আদেশ পাইনি। পেলে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়া হবে।’

এর আগে দু’জন মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে জাল দলিল তৈরির অভিযোগে ২০১৪ সালের ২৩ জুলাই চট্টগ্রাম বিশেষ জজ আদালতে মামলা করেন রাউজান উপজেলার বাসিন্দা মনসুরুল হাসান চৌধুরী। মামলাটি এখনও আদালতে বিচারাধীন।

এ ছাড়া একজনের স্থলে অন্যকে দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করানোর ঘটনা ঘটেছে নগরীর পাহাড়তলী সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। এ ঘটনায় পাহাড়তলী সাবরেজিস্ট্রার মো. সিরাজুল করিম বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় ৫ জনকে আসামি করে এজাহার দায়ের করেন। এজাহার থেকে জানা যায়, ৩০ আগস্ট বেলা ২টায় একটি হেবার ঘোষণা দাখিল করা হয়। যার দলিল গ্রহীতা লাকসাম থানাধীন ইকবাল নগর এলাকার আবদুল বারীর ছেলে মোহাম্মদ সামছুর রহমান। এ দলিলে দাতা দেখানো হয় কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার রাজপুর এলাকার মোহাম্মদ সামছুর রহমানের স্ত্রী মুক্তা আরা জাহানকে। এ সময় দলিলদাতার কাছে সাবরেজিস্ট্রার জাতীয় পরিচয়পত্র দেখতে চাইলে সঙ্গে নেই বলে উল্লেখ করেন। জমি কাকে দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে মুক্তা আরা জাহান জানান, তার স্বামীকে দিচ্ছেন। এ সময় তার কাছে স্বামী ও শ্বশুরের নাম জানতে চাইলে তিনি ঠিকভাবে কিছুই বলতে পারছিলেন না। এতে সাবরেজিস্ট্রারের সন্দেহ হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে ওই নারী জানান, তিনি প্রকৃত মুক্তা আরা জাহান নন, তার প্রকৃত নাম ডলি। জনৈক জোনায়েদ ও দলিল লেখক তজিম উদ্দিন তাকে ও তার স্বামী মোশারফকে ৫ হাজার টাকা দেয়ার লোভ দেখিয়ে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ে আসেন। এ ঘটনায় পুলিশ দলিল লেখক জোনায়েত আলী ও মোশারফ হোসেনকে গ্রেফতার করে।

স্বাক্ষর জাল করে দলিল তৈরির অভিযোগে ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করেন এসএম বাবর নামে চান্দগাঁও থানাধীন বাদুরতলা এলাকার এক বাসিন্দা। ওই মামলায় সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সাবরেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলুর রহমান, পিয়ন লিয়াকত আলী, কাজী হামিদা বেগম, আবদুল মান্নানসহ চারজনকে আসামি করা হয়।

এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী এসএম বাবর যুগান্তরকে জানান, ‘চট্টগ্রাম সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ৩১৪ নম্বরের একটি দলিলে আমার নাম-ঠিকানাসহ ছবি আছে। কিন্তু আমি ওই দলিলে স্বাক্ষর করিনি।’

মামলাটি তদন্ত করছেন কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) নুর মোহাম্মদ। তিনি যুগান্তরকে জানান, আদালতের নির্দেশে জাল দলিলটি জব্দ করা হয়েছে। পরে তা বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

১ আগস্ট খোদ সাতকানিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিস যে জমিতে অবস্থিত সেই জমিও ভুয়া দলিলে বিক্রির ঘটনা ঘটে। ভুয়া বিক্রেতা নূর আহমদ ওরফে নূরুল আলম ২০ শতক জায়গা ৭৬ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। পরে দলিলটি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম দলিল লেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম. মোক্তার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘দলিল লেখার বিষয়টি এখন শুধু দলিল লেখকদের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। চট্টগ্রামে সম্পাদিত দলিলের ৮০ শতাংশই করছেন আইনজীবীরা। বাকি ২০ শতাংশ করছেন দলিল লেখকরা। কতিপয় ব্যক্তি তথা দলিল লেখক অর্থের লোভে মাঝে মাঝে ভুয়া দলিল করে থাকে। সমিতির লোক হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। বাইরের কেউ তথা আইনজীবী হলে সেক্ষেত্রে আমাদের কিছুই করার থাকে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comment moderation is enabled. Your comment may take some time to appear.