আজ : ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News

প্রধানমন্ত্রীর শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়ার আহ্বান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে শতভাগ নিরক্ষরমুক্ত করতে সকল শ্রেণীপেশার নাগরিকদের এগিয়ে আসার আহবান জানিয়ে বলেছেন, সকলের অংশগ্রহণেই দ্রুততম সময়ে আমারা দেশকে নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করতে পারবো।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকলের উদ্যোগেই আমরা এদেশকে খুব দ্রুতই নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করতে পারবো। যদি সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে স্ব-স্ব এলাকার নিরক্ষরদের শিক্ষিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০১৬’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করতে দেশের ছাত্র সমাজ, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল ও তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা দেশের সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশে উন্নীত করতে সমর্থ হয়েছি। সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা আছেন, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আছেন, পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা এবং বিভিন্ন শ্রেণীপেশার নাগরিকরা রয়েছেন-প্রত্যেকেই যদি উদ্যোগ নেন… আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশটা আমাদের। আমাদেরই এই দেশকে গড়ে তুলতে হবে। যাতে আমরা মর্যাদার সাথে চলতে পারি। দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে এবং দারিদ্রমুক্ত করতে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।’
প্রাধমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ আসিফউজ্জামান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রুহুল আমিন সরকার অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা’র একটি শুভেচ্ছা বাণীও পড়ে শোনানো হয়।
তিনি বলেন, ‘সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা আছেন, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আছেন-পাশাপাশি যেসকল সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা রয়েছেন এবং বিভিন্ন শ্রেণীপেশার নাগরিকরা যারা রয়েছেন-প্রত্যেকে যদি উদ্যোগ নেন- আমাদের এলাকায় কোন নিরক্ষর থাকবে না এবং আপনি তাদের সাহায্য করবেন। স্ব-স্ব উদ্যোগ নিলেই আপনারা দেখবেন-আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই দেশটা আমাদের। আসুন সকলে মিলে আমরা এই দেশকে গড়ে তুলি। যাতে আমরা মর্যাদার সাথে চলতে পারি। আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।’
তিনি বলেন, আমি শিক্ষকদের উদ্দেশে বলব, আপনারা একটা মহৎ পেশায় আছেন। জাতির পিতা প্রায়ই বলতেন ‘সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ চাই।’ আপনারা হচ্ছেন সেই মানুষ গড়ার কারিগর।
তিনি বলেন, ‘আপনারা পারেন-নীতি ও মূল্যবোধের চর্চা শিখিয়ে দেশের প্রতিটি শিশুকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। ভালো-মন্দ কিংবা ন্যায়-অন্যায় বিবেচনার জ্ঞান এবং দেশাত্মবোধের শিক্ষা দেয়া আপনাদের দায়িত্ব।’
তাঁর সরকারে শিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ’৯৬-এ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলাম। আমাদের পদক্ষেপের ফলে মাত্র দু’বছরে সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এ অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ ‘ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার ১৯৯৮ লাভ করে। কিন্তু পরে বিএনপি-জামাত জোটের ২০০১-২০০৬ শাসন আমলে সাক্ষরতার হার বাড়েনি। উল্টো কমে ৪৪ শতাংশে নেমে যায়।
দেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭১ শতাংশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সাক্ষর জ্ঞানহীন মানুষ দৃষ্টিশক্তি থাকতেও এক ধরনের দৃষ্টিহীনতায় ভোগেন। তাই সবার মনের-জ্ঞানের চোখ খুলে দিতে, আপন ভাল-মন্দ বুঝে নিতে আমরা ব্যাপক ভিত্তিক সাক্ষরতা কার্যক্রম গ্রহণ করেছি।’
তিনি প্রতিবছর ১ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা গত ৭ বছরে বিনামূল্যে ১৯৩ কোটি বই বিতরণ করেছি। পহেলা জানুয়ারী ২০১৬ দেশব্যাপী ‘বই উৎসব’ পালিত হয়েছে।’
প্রাথমিক ও গণমুখী শিক্ষার প্রসারে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রসংগে প্রধানমন্ত্রী বলেন- তাঁর সরকার ২০১০ সালে আধুনিক-বিজ্ঞানসম্মত জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা-শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ, আচরণ ও ভাষা শিখানোর মৌলিক স্তর হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।
মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বৃত্তি উপবৃত্তি চালুর কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট হতে বিভিন্ন পর্যায়ে দেড় হাজার জন দরিদ্র-মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি দিচ্ছি।
তিনি বলেন, ১০০০ কোটি টাকার সীড মানি দিয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন করেছি। এখান থেকে প্রাথমিক হতে ডিগ্রী পর্যন্ত ১ কোটি ২৮ লাখ ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। সারাদেশের ৪ হাজার ৯০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করতে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ সরঞ্জাম দেয়া হয়েছে।
এখন দেশে উপবৃত্তি প্রাপ্তের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লক্ষ। ২০১০ সালে উপবৃত্তি প্রাপ্তদের সংখ্যা ৪৮ লক্ষ থেকে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৭৮ লক্ষ করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, ৪৫২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প ৬৪ জেলা’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ ২০১৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত রার প্রসংগ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সহকারি শিক্ষকের বেতন একধাপ বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ছাত্র-ছাত্রী ঝড়েপড়ার হার আমরা ২৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে ২০০৭ সালে ঝরপেড়ার হার ছিল ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ। ঝড়েপড়া রোধকল্পে মিড-ডে মিল চালুর জন্য সমাজের বিত্তবানদের তিনি এগিয়ে আসার আহবান জানান।
তিনি বলেন, ‘মিড-ডে মিল কর্মসূচী ৯৬টি দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলার ৩৩ লক্ষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চালু করেছি। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পর্যায়ক্রমে সকল স্কুলে মিড-ডে মিল চালু হবে।’
শিশু কল্রাণ ট্রাস্ট এবং আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠায় সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট্রের আওতায় ৯১টি ‘শিশু কল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেছি। এসব বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা ২০ হাজার। এদের প্রাথমিক স্তরে ৬০০ ও মাধ্যমিক স্তরে ৮০০ টাকা করে প্রতিমাসে বৃত্তি দেয়া হয়।
তিনি বলেন, দেশের ৫২টি জেলার ১৪৮টি উপজেলায় ১ হাজার ১৪০ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১২ হাজার ৫৬৭টি ‘আনন্দ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেছি। ফলে ঝরেপড়া ৭-১৪ বছর বয়সী ৭ লক্ষ ২০ হাজার শিশু দ্বিতীয় বার প্রাথমকি শক্ষিার সুযোগ পেয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আনন্দ স্কুলে বিনামূল্যে বই দেয়ার পাশাপাশি বিনামূল্যে পোশাক ও উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে আনন্দ স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ৩ লক্ষ ৪২ হাজার ১৩৬ জন।
তিনি বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ে ধারণা দিতে ‘সুস্বাস্থ্যে-সুশিক্ষা’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। ৩৯ হাজার ৩০৩টি গভীর নলকূপ স্থাপন পরিকল্পনার আওতায় ২৫ হাজার ৬২১টি স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত হ্রাস পেয়েছে।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং ক্রীড়ানৈপূণ্য বাড়াতে প্রাথমিকে ছাত্রদের জন্য বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ এবং ছাত্রীদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১০ সাল থেকে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ‘স্টুডেন্টস কাউন্সিল’ গঠিত হচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষণের জন্য কক্সবাজারে ‘লিডারশীপ ট্রেনিং সেন্টার’ নির্মিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য হুইল চেয়ার, হিয়ারিং এইড, ক্র্যাচসহ অন্যান্য সরঞ্জাম প্রদান করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতার শুরুতেই দেশের প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশে জাতির পিতার কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠনসহ যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ পুনর্গঠনকালেই সারাদেশের ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমকি বদ্যিালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষকের পদ সরকারিকরণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের তথ্য তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জাতির পিতার কর্মকা- ও চিন্তাভাবনা অনুসরণ করে একটা কথা বলি-শিক্ষা সুযোগ নয়, শিক্ষা অধিকার। শিক্ষাই পারে-দারিদ্র্য মুক্ত, আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়তে। দেশে এখন প্রাথমিক শিক্ষাসহ সব ধরণের শিক্ষার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের ৪০ বছর পর আমিই ২০১৩ সালে দেশের ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছি।’
তিনি বলেন, সেদিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১লাখ ৩ হাজার ৮৪৫জন শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণের ঘোষণা দিয়েছিলাম। আমরা ঘোষিত পদের চেয়ে ৫ হাজার বাড়িয়ে ১ লাখ ৮ হাজার ২০০ শিক্ষকের চাকরি সরকারি করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষার মাধ্যমে আমরা জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনেছি। সারা বিশ্বে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম বলে ছেলেমেয়ে সমতা আনার কথা বলা হয়। আর আমাদের দেশে উল্টো। এখানে মেয়েদের সংখ্যা বেশি বলে এখন ছেলেদের এগিয়ে আনতে হবে।’
তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘বইপত্র কোন সাজিয়ে রাখার বস্তু না, তোমাদের পড়তে হবে। জ্ঞান অর্জন করতে হবে। আগামীতে তোমাদের মধ্য থেকেই দেশের নেতা-প্রধানমন্ত্রী হবে। কাজেই সেভাবেই নিজেদেরকে তৈরী করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানের বক্তৃতা পর্ব শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comment moderation is enabled. Your comment may take some time to appear.