বাংলাদেশের অন্তত ১৬টি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এবার বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জুলাই মাসে শুরু হওয়া এ বন্যায় সরকারি হিসেবেই ৩৪ লাখের বেশি মানুষ দুর্গত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের জেলা জামালপুরে ইতিহাসে সর্বোচ্চ পানি উঠেছে।
২৮শে জুলাই যমুনার পানি বিপদসীমার ১২১ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর প্রভাবে জামালপুরের নিচু এলাকা এবং চরাঞ্চল তলিয়ে যায়।
বহু বাড়ি-ঘর এমনকি প্রধান সড়কও পানিতে তলিয়ে গেছে এ বন্যায়। পানি বন্দী হয় দেড় লাখের বেশি পরিবার। পানি কমতে শুরু করলেও পয়লা আগস্ট জেলার ইসলামপুর ইউনিয়ন ঘুরে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে পানি দেখা যায়I ফসলি জমি, মাঠ-ঘাট সবই ছিল পানির নিচে। সাময়িক বন্ধ হয়ে যায় শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ইসলামপুর উপজেলার মাদ্রাসা শিক্ষক হজরত আলী সড়কের কালভার্টের কাছে মাচায় বসে মাছ শিকার করছিলেন।
যে সড়কে বসে তিনি মাছ ধরছিলেন তার ওপর দিয়ে এতটা পানি আছে যে নৌকা এবং ট্রলার পাড়ি দিচ্ছে। মিস্টার আলী বলেন, “এখান দিয়ে রাজীব বাস জননী পরিবহন চলে। যেগুলো ঢাকা যায়। এখনতো ট্রলার চলতিছে।”
এ সড়কের ওপর দিয়ে এত পানি আগে কখনো দেখেননি বলে জানান মিস্টার আলী।
বাংলাদেশের অন্তত ১৬টি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এবার বন্যায় প্লাবিত হয়েছে
নৌকায় চড়ে আরেকটু গ্রামের ভেতর গিয়ে দেখা যায় মানুষের দুর্ভোগের চিত্র।
ইসলামপুর উপজেলার দিলীরপাড় গ্রামের ছবু শেখ বলেন, এই প্রথম তার ঘরে পানি উঠলো।তিনি বলেন, “৮৮ সালের চেয়েও বড় বন্যা হইছে। ২৫ বছর বাড়ী করছি কোনোদিন ঘরে পানি ওঠে নাই”
জামালপুরে ১৯৮৮ সালে পানি উঠেছিল বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার উপরে কিন্তু এবার সেটি ১২১ সেন্টিমিটার উঠে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।
জামালপুরে অতিরিক্ত পানির কারণে গবাদি পশু হাঁস-মুরগি নিয়ে অনেকেই দুরবস্থার মধ্যে পড়ে। বন্যার পানি ঘরে ঢুকে পড়ায় বসত ভিটা ছাড়তেও বাধ্য হয় অনেকে। এবারই প্রথম বন্যার পানিতে ঘর ডুবেছে জাকিয়া বেগমের।
নিজের বাস্তুভিটা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন এক প্রতিবেশীর ঘরে। নাজমা বেগম বলেন, “ঘরে পানি উঠছে ছয় দিন হইলো। তিনডা ছেলে আছে স্বামী আছে ওরা ওই রাস্তাত উঠছে”।
জামালপুর ছাড়াও দেশের অন্তত ১৬টি জেলায় এবার বন্যার কবলে পড়েছে। এ বন্যার কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে প্রতিবেশী ভারতের কয়েকটি রাজ্য এবং নেপালের বন্যা।
নেপাল ও ভারতে অতিবৃষ্টি এবং বন্যার পানি ব্রহ্মপুত্র যমুনা দিয়ে ঢুকেছে বাংলাদেশে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোঃ জাহাঙ্গীর কবির বলেন, এবার বন্যা হয়েছে যমুনার পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে।
তিনি বলছেন,“আমাদের দেশে তিনটা মেইন রিভার সিস্টেম, যমুনা রিভার সিস্টেম, গ্যাঞ্জেস রিভার সিস্টেম আর একটা হচ্ছে মেঘনা রিভার সিস্টেম। এই রিভার সিস্টেমের যে ক্যাচমেন্ট এরিয়া তার ৯৩ শতাংশ বাংলাদেশের বাইরে। নেপাল, ভুটান, ইন্ডিয়া এবং পার্টলি চায়নার। নেপাল এবং ইন্ডিয়ায় বৃষ্টিপাতের কারণেই কিন্তু যমুনায় পানি বাড়ছে। যদি দুইটা ক্যাচমেন্টে পানি একসঙ্গে আসে তাহলে বন্যা বেশি সময় ধরে হয়”।
বন্যায় পানি বন্দী হয়ে রয়েছে অনেক পরিবার
বাংলাদেশের বিভিন্ন নদনদীর ৯০ পয়েন্ট পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস এবং সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
তারা বলছে বন্যার পানি দীর্ঘদিন আটকে থাকলেই সেটাকে ভয়াবহ বন্যা বলা যায়। এবারের বন্যায় কিছু জায়গায় পানি বেশি হয়েছে কিন্তু সেটা ১৯৮৮ কিংবা ১৯৯৮ সালের মতো ভয়াবহ নয়।
মিস্টার কবির বলেন, “এবারটা অস্বাভাবিক উচ্চতা দেখা গেছে যমুনার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে। যদিও এটি কম সময় স্থায়ী ছিল। ব্রহ্মপুত্রের পানি কুড়িগ্রাম, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ হয়ে নিচের দিকে চলে আসছে। দেখা যাচ্ছে নিচের দিকে পানি বাড়ছে। এখন যদি বৃষ্টিপাত না হয় তাহলে দুই তিনদিনের মধ্যে এ পানি নেমে যাবে এবং বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে”।
বলা হচ্ছে এবার বাংলাদেশে কোথাও দীর্ঘ সময় ধরে পানি আটকে থাকেনি বলে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেনি। তবে গত প্রায় এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটি বড় বন্যার অভিজ্ঞতা।