সারা দেশে র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের অব্যাহত অভিযান সত্ত্বেও মাদকের আগ্রাসী থাবা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারি কঠোর পদক্ষেপের মধ্যেও মাদক ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে, সচল রয়েছে তাদের সরবরাহব্যবস্থাও। মাদক আমদানি, সরবরাহ ও বিপণনব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে তারা। এসব নিত্যনতুন কৌশলে পাচার হওয়া মাদক ধরতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। ইদানীং বাকপ্রতিবন্ধীদের (বোবা) মাধ্যমেও পাচার হচ্ছে ইয়াবা। এতে ইয়াবাসহ বোবারা ধরা পড়লেও তারা মূল মাদক ব্যবসায়ীর নাম-পরিচয় কিছুই জানাতে পারে না, দিতে পারে না স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। অন্যদিকে একশ্রেণির হিজড়া আনা-নেওয়া করছে ফেনসিডিল। তা ছাড়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের স্টিকার, জেলা প্রশাসন ও পুলিশের স্টিকার লাগানো গাড়ি ব্যবহার করেও মাদক পাচার করছেন ব্যবসায়ীরা। দেশের অভ্যন্তরীণ ৪৭টি রুটের যানবাহন ও ট্রেনে অবাধে আনা-নেওয়া চললেও খুবই সীমিত পরিমাণ মাদক আটক করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রাজধানীর সর্বত্রই মাদক ব্যবসায়ী আর নেশাখোরদের চলছে দাপুটে তত্পরতা। গত বছরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রেকর্ডপত্রে নগরীতে ৫৪২টি মাদক স্পট ছিল, এখন সে সংখ্যা বেড়ে হাজারে পৌঁছেছে। বনানী থানা এলাকায় মাদকের বেশ কয়েকটি আস্তানা গড়ে উঠেছে। সাততলা বস্তি এলাকায় কামরুল, সীমা, পিংকু, রুমা, রুবেল, জামাই নাজিমুদ্দিন, সোহেল অবাধে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড পয়েন্টে রিজু, মানিক, গেন্দা বাবু গড়ে তুলেছে পাইকারি মাদক ব্যবসা। মাস্টার আলমগীর, জলিল, বেলতলার ফুল মিয়া, নূরুসহ সাত-আট জনের বিরুদ্ধে মাদকসংক্রান্ত ২০-২২টি করে মামলা রয়েছে। তারা কয়েক দফা গ্রেফতার ও হাজতবাস করলেও তাদের মাদক ব্যবসা বন্ধ করা যায়নি।
এক চিত্রনায়িকার স্বামী এখন বনানীতে ইয়াবা বাণিজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। থানা পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে মাসোহারা লেনদেন থাকায় তার সিন্ডিকেট ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে। তার সরবরাহ করা ইয়াবায় বনানী ও এয়ারপোর্ট রোডসংলগ্ন বিভিন্ন আবাসিক হোটেল যেন মাদকের হাটে পরিণত হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের অন্তত ৩০ সদস্য ইয়াবা কেনাবেচায় সক্রিয় রয়েছে।
এদিকে বাড্ডার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গোটা বাড্ডাকে মাদক কেনাবেচা ও সেবনের খোলা বাজারে পরিণত করা হয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন আর হয়রানি। বাড্ডা ঘুরে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে মাদক আখড়াগুলোকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। বাড্ডার মোল্লাপাড়ায় বাজার গলিতে ফেনসিডিল ও ইয়াবার বড় স্পট। মাদক আস্তানাটি পরিচালনা করে মোজাম্মেল, ফজলু, ফর্মা শহিদ, ফর্মা টিপু। তারা সবাই একটি বাহিনীর সদস্য। কবরস্থান রোডের পাঁচতলা এলাকার বড়টেকে গড়ে তোলা মাদক স্পটটি পরিচালনা করে সাইফুল, কামরান এবং পাশের অন্য মাদক স্পটটি চালায় বাঁধন, পল্লব, ভাগ্নে ফরিদ, জয়। বাড্ডার আনন্দনগর এলাকার মসজিদসংলগ্ন গলিতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে জামাই বাছেদ, আলী, নূরনবী, রাসেল, রমজান, বেল্লা, রফিক, চাঁড়াইলা রিপন, ফর্মা শহিদ। আফতাবনগরে মাদক পরিচালনা করে বেল্লাল। বাড্ডা থানাসংলগ্ন পশ্চিম পাশে মাদকের আস্তানা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতি রাতেই সেখানে বসে জমজমাট জুয়ার আসর। ভাটারা থানার অলিগলি সর্বত্রই মাদকে সয়লাব হয়ে পড়েছে। খিলবাড়ীরটেক খালপাড়, নূরেরচালা, বৌবাজার, শাহজাদপুর, নতুনবাজারের মোড়ে মোড়ে মাদকের ছড়াছড়ি। শাহজাহানপুর থানা গেট ঘেঁষে ১০ গজের মধ্যে সবচেয়ে বড় মাদক স্পট গড়ে উঠেছে। সেখানে ইয়াবা, ফেনসিডিল বিক্রির মূল হোতা স্থানীয় এক ছাত্রলীগ নেতার ভাই খোঁড়া মানিক ওরফে দয়াল মানিক। ডিএমপি মতিঝিল বিভাগের এক কর্মকর্তা এই মাদক হাটের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে ১০টিরও বেশি সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে মাদক কেনাবেচার পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো ও আশপাশ এলাকার মাদক বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কেরফা বিল্লাল নামে একজন। ফকিরাপুল গরমপানি গলিতে জাপানি বাবু গড়ে তুলেছে ইয়াবার পাইকারি বাজার। শান্তিবাগ ঝিল মসজিদ এলাকায় লিটন, সোহেল; আমতলায় উজ্জ্বল, নূরা; শাহজাহানপুর রেলগেট বাজারে মুরগি মাসুম, ইকবাল; শহীদবাগে হোন্ডা মিলনের মাদক বিক্রি থামানোর সাধ্য যেন কারও নেই। খিলগাঁও তিলপাপাড়া কালভার্ট এলাকায় হিজড়া সিন্ডিকেট মাদক কেনাবেচার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। সেখানে ময়নার নেতৃত্বে শাহ আলম, রুবি, সনেকা, নাচনেওয়ালি, মিতু, সাবের, সালামসহ ১৫-১৬ জন নকল হিজড়ার সমন্বয়ে সংঘবদ্ধ একটি চক্র রয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে খিলগাঁও ঈদগাহ মসজিদ এলাকার মাদক ব্যবসায়ী রেখা আক্তার ফাতেমা ও গোড়ান ঝিলপাড়ের মাদকসন্ত্রাসী হান্নান।
আসক্ত হচ্ছে তরুণীরা : আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো দিন দিন ইয়াবা আসক্ত তরুণীর সংখ্যা বাড়ছে। বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলেবন্ধু বা মেয়েবন্ধুর মাধ্যমে অনেকেই এ জগতে প্রবেশ করছে। অনেকে আবার স্রেফ কৌতূহলের বশেও এক-দুবার ইয়াবা সেবন করে স্থায়ীভাবে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই রয়েছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ এবং পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ইয়াবার ভয়াবহতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল সব মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। তরুণ-যুবক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ সুযোগে রাজধানী জুড়ে গড়ে উঠেছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অপ্রতিরোধ্য নেটওয়ার্ক। এর মধ্যে ‘ডিরেক্ট পার্টি’ নামে পরিচিত পাইকারি বিক্রেতার সংখ্যাই তিন শতাধিক। বিভিন্ন সূত্রমতে, প্রতিদিন শুধু রাজধানীতেই তিন থেকে চার লক্ষাধিক পিস ইয়াবা বিক্রি হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাঝেমধ্যেই ধরা পড়ছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা, প্রচুর ইয়াবাও উদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও মরণঘাতী এ মাদকটির দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, থাই ভাষায় ইয়াবা মানে ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ওষুধ। ইয়াবা এক ধরনের মাদক যা হেরোইনের চেয়ে ভয়াবহ এবং হেরোইনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইয়াবার মূল উপাদান মেথ্যাম ফিটামিন ও সঙ্গে থাকে উত্তেজক পদার্থ ক্যাফিন। ২৫ থেকে ৩৫ মিলিগ্রাম মেথ্যাম ফিটামিনের সঙ্গে ৪৫ থেকে ৬৫ মিলিগ্রাম ক্যাফিন মিশিয়ে তৈরি এ ট্যাবলেটের রং সাধারণত সবুজ বা লালচে কমলা হয়ে থাকে। নথিতে বলা হয়, ইয়াবা ট্যাবলেটের স্বাদ যে কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে এবং সেবনের পর ধরা পড়ার সম্ভাবনাও থাকে না। ইয়াবা ব্র্যান্ডের এসওয়াই, এনওয়াই ও ডব্লিউওয়াই নামের তিনটি ট্যাবলেট বাজারে পাওয়া যায়।