বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ভূয়া সিম পাওয়া গেলেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা অপারেটরের বিরুদ্ধে প্রতিটি সিমের জন্য ৫০ডলার করে জরিমানা করার কথা বলেছে বিটিআরসি।
কারও অগোচরে আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে ভিন্ন সিম নিবন্ধনের অনেক অভিযোগ রয়েছে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিও এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করে।
বিশ্লেষকদের অনেকে বলেছেন,সিম বিক্রির ব্যবস্থাপনা এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজে দুর্বলতার কারণে এমন অপরাধ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইল সিমের নিবন্ধন জালিয়াতির অভিযোগে পুলিশ সম্প্রতি যে সব এলাকায় অভিযান চালিয়েছে।
এমন একটি এলাকা ঢাকার আদাবরে গিয়ে সিম বিক্রির ব্যক্তি মালিকানাধীন কয়েকটি দোকানে কথা বলতে চাইলে,এর মালিকরা তাতে রাজি হননি।তবে সেখানে পরিচয় হয় এ ধরণের জালিয়াতির শিকার কম্পিউটার ব্যবসায়ী শুভ আহমেদের সাথে।
তিনি বলছিলেন, “আমার নামে অতিরিক্ত পাঁচটি সিম নিবন্ধন করা হয়।সেগুলোর ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না।কোনো অপরাধীর কাছে সেসব সিম চলে গেছে কিনা, তাও জানিনা।এর দায় তাহলে কে নেবে?”
তিনি আরও বলেছেন, তিনি থানা পুলিশ এবং মোবাইল কোম্পানির কাছে অভিযোগ করার পরও এখনও কোনো প্রতিকার পাননি।
যার আঙ্গুলের ছাপ নেয়া হয়েছে,তিনি জানতেই পারেননি যে তাঁর নামে ভিন্ন সিম নিবন্ধন হয়ে গেছে।সেই সিম চলে গেছে অন্য কারও হাতে।
আদাবরের শুভ আহমেদের মতো ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য জায়গা থেকেও অনেকে এ ধরণের জালিয়াতির শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।
এ নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা রয়েছে।
বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ মনে করেন,জালিয়াতির ঘটনা বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের উদ্দেশ্যকে আঘাত করেছে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেছেন, এমন জালিয়াতির ঘটনা বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের উদ্দেশ্যকেই আঘাত করেছে।সে কারণে এটি উদ্বেগের বলে তিনি মনে করেন।
“এটা নি:সন্দেহে উদ্বেগের বিষয়।বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধনের উদ্দেশ্যই ছিল যে, যাতে আমার নামের সিম অন্য কারও হাতে না যায়।এত ঢাকঢোল পিটানোর পরও যে ঘটনাটা ঘটলো,এটা অথ্যন্ত দু:খের বিষয়।এটার জন্য কিন্তু আমরাই দায়ী। কারণ কেউ নিবন্ধন করতে গেলে কোনো অসাধু খুচরা সিম বিক্রেতা কয়েকবার আঙ্গুলের ছাপ নিয়েছে।সেটা হয়তো ঐ গ্রাহক খেয়ালই করেননি বা বুঝতে পারেননি।আর এখানেই হয়েছে মুল সমস্যা।”
তিনি জানিয়েছেন, ঢাকার আদাবর,চট্টগ্রাম,নাটোর এবং ময়মনসিংহ সহ কয়েকটি জায়গায় এমন সিম জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে।
গত ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাড়ে তিন মাস ধরে সারাদেশে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে এই সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলেছে।
মাস খানেক আগে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং রাজধানী ঢাকার তেজগাঁ এলাকায় পুলিশী অভিযান সাড়ে চার হাজারের মতো সিম উদ্ধার করা হয়।
এসব সিমের নিবন্ধন বা কাগজপত্র যাদের নামে হয়েছে, তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
পুলিশের তেজগাঁ অঞ্চলের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলছিলেন, একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তে সিম জালিয়াতির বিষয় উঠে আসে।এরপরই বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হয়।
তেজগাঁয়ে সিম জালিয়াতির অভিযোগে একটি মোবাইল কোম্পানির মাঠ পর্যায়ের তিনজন কর্মকর্তাও গ্রেফতার রয়েছে।
যদিও বিটিআরসি মনে করে এর দায় সংশ্লিষ্ট সকলের।
একইসাথে সংস্থাটি বলছে,মাঠপর্যায়ে সিমের খুচরা বিক্রেতাদের অনেকেই গ্রাহকের আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে প্রতারণা করেই এসব অপরাধ করেছে।
গ্রামীণ ফোন, রবি বা বাংলা লিংক, বেসরকারি এই মোবাইল অপারেটরদের কেউ সিম জালিয়াতির প্রশ্নে কথা বলতে চায়নি।
মোবাইল কোম্পানিগুলোর সমিতি অ্যামটবের মহাসচিব নুরুল কবির জালিয়াতির দায় চাপিয়েছেন খুচরা সিম বিক্রেতাদের ওপর।
অপরেটরদের পক্ষে তাদের সমিতি অ্যামটবের মহাসচিব নুরুল কবির দায় চাপালেন মাঠের সিম বিক্রেতাদের ওপর।তিনি বলছিলেন, “সরকার এবং বিটিআরসি,সকলেই বলছে, অপারেটরদেরই দায় নিতে হবে।ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু সারাদেশে হাজার হাজার খুচরা সিম বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব শুধু অপারেটরদের চাপিয়ে দিলে চলবে না।কর্তৃপক্ষ এবং আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীকেও ভূমিকা রাখতে হবে।”
ঢাকার মহাখালী এলাকায় একটি মার্কেটে গিয়ে সিম বিক্রির বেশ কয়েকটি দোকান দেখা যায়।
এমন বিক্রেতাদের দিকেই যে অভিযোগের অঙ্গুল তোলা হচ্ছে, সেই অভিযোগ সম্পর্কে সেখানে একজন দোকান মালিক মো: ফয়সাল বলছিলেন, খুচরা বিক্রেতারা কর্তৃপক্ষের দেয়া নিয়মের বাইরে যায়নি।জালিয়াতির ঘটনাগুলোর দায় মোবাইল কোম্পানি বা অপারেটরদের ওপরই বর্তায় বলে তিনি মনে করেন।
কোন প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির ঘটনাগুলো ঘটেছে, সে ব্যাপারে সব পক্ষই একমত।
কিন্তু দূর্বলতা কোথায় ছিল, সেই প্রশ্নে কেউ দায় নিতে রাজি নয়।
টেলিয়োগাযোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ খান মনে করেন, সিম বিক্রির ব্যবস্থায় যেমন সমস্যা রয়েছে।একইসাথে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজেও দূর্বলতার কারণে এমন অপরাধ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
“সিম বিপণন ব্যবস্থায় ত্রুটি রয়েছে।এই ব্যবস্থায় কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য আছে।অন্যদিকে একজন মানুষের আঙ্গুলের ছাপ দশ বা বিশবার জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেজে বা তথ্যভান্ডারে রেকর্ড হচ্ছে।কোনো সতর্ক বার্তা দিচ্ছে না। এটা বিশ্বাসযোগ্য হয় না। কিন্তু এমন দুর্বলতা পাওয়া গেছে।এসব কারণেই জালিয়াতি হয়েছে।”
গ্রাহকের হাতে থাকা মোবাইল সিমের সংখ্যা ছিল ১৩কোটি ২০লাখ।বায়োমেট্রিকে নিবন্ধিত হয়েছে ১১কোটি ৬০ লাখ।
এর মধ্যে জালিয়াতির অভিযোগ কত এসেছে, সে ব্যাপারে বিটিআরসি বা কোম্পানিগুলো এবং পুলিশ কেউই সঠিক কোনো সংখ্যা দিতে পারছে না।
অ্যামটব এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পাঁচ হাজারের মতো সিম জালিয়াতি হয়েছে বলে তাদের ধারণা।একইসাথে অ্যামটবের নুরুল কবির বলেছেন, তারা এগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন, সেটাকেই সাফল্য হিসেবে দেখছেন।
কিন্তু পুলিশী অভিযানে যেগুলো ধরা পড়েছে, তার তদন্তইবা কতটুকু এগিয়েছে, সেটা কেউ বলছে না।
টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
তবে বিটিআরসির শাহজাহান মাহমুদের বক্তব্য হচ্ছে, জরিমানা করাসহ কঠোর কিছু ব্যবস্থা তারা নিচ্ছেন।
তিনি বলছিলেন, “এখন জালিয়াতির সিম পাওয়া গেলেই কোম্পানির বিরুদ্ধে প্র্রতিটি সিমের জন্য ৫০ ডলার জরিমানা করা হবে। তবে কোনো অপারেটর জালিয়াতির সাথে জড়িত প্রমাণ হলে তিন কোটি থেকে তিনশ কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার আইন আছে।অপারেটরদের যোগসূত্র থাকা না থাকার প্রশ্ন তদন্তের জন্য আমরা তদন্ত দল গঠন করছি।”
তবে আবু সাঈদ খান বরেছেন, নাগরিকদের বিপদজনক একটা পরিস্থিতি থেকে বাঁচানোর প্রশ্ন এখানে রয়েছে।কারণ আসল গ্রাহকের অগোচরে কোনো সিম জঙ্গী বা কোনো অপরাধীর হাতে পড়লে ঐ গ্রাহককেই হয়রানি পোহাতে হতে পারে।সেজন্য কত সংখ্যক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এর হিসাব আগে নেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্লেষকরা এটাও বলছেন যে, মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সমস্যা বা দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তা প্রকাশ করা উচিত।
তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, সর্ব্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েই তারা পদক্ষেপ নিচ্ছে।