আজ : ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News

রবীঠাকুরের ৭৫তম প্রয়াণদিবস শনিবার

বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণবার্ষিকী ২২ শে শ্রাবণ। ঘন বর্ষার স্রোতধারা নিয়ে বড় ভালবাসায় যে তাঁর অবিনশ্বর গানের সৃষ্টি করেছেন সে বর্ষাতেই তিনি পৃথিবী ছেড়েছেন। সে এক আশ্চর্য সুন্দরের ইতিহাস! শুধু বর্ষা নয় ষড়ঋতু নিয়েও তিনি অসংখ্য গান রচনা করেছেন। আর সেসব গানে প্রকাশ পেয়েছে মানুষের যাপিত জীবনের নানাবিধ দিক। সে কারণেই বাঙালির সুখে-দুখে তাঁর যাপিত জীবনের অধ্যায়ন ও তাঁর গান খুব বেশি প্রাসঙ্গিক।

বিশ্বকবির ৭৫তম প্রয়াণবার্ষিকী শনিবার

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনিবার্য এই কবি ৭৫ বছর আগে ১৯৪১ সালের ৬ আগস্ট, বাংলা ১৩৪৮ সনের ২২ শ্রাবণ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির শ্যামল প্রাঙ্গণে পরলোকগমন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ জন্ম-মৃত্যুর মাঝে তফাত দেখেছেন খুব সামান্যই। সৃষ্টিই যে এই নশ্বর জীবনকে অবিনশ্বরতা দেয়, সে কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন বলেই তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু দিয়ে যে প্রাণের মূল্য দিতে হয়/ সে প্রাণ অমৃতলোকে / মৃত্যুকে করে জয়।’ তিনিই আবার জীবনসায়াহ্নে লিখেছিলেন- ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যখন ইহধাম ত্যাগ করেন সেদিন শোকার্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিগুরুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছিলেন, ‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপারে কোলে/ বাংলার কবি শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি তুমি চলে যাবে বলে/ শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে দলে।’

৮০ বছর বয়সে চলে গেলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ মৃত্যু দেহান্তর মাত্র। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক কিছুরই প্রথম স্রষ্টা তিনি। তিনি পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার শিল্প-সাহিত্যও পরিণত হয়েছে। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য নতুন রূপ লাভ করে। বাংলা গদ্যের আধুনিকায়নের পথিকৃৎ রবিঠাকুর ছোটগল্পেরও জনক। গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, প্রবন্ধে, নতুন নতুন সুরে ও বিচিত্র গানের বাণীতে, অসাধারণ সব দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধে, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতিসংলগ্ন গভীর জীবনবাদী চিন্তাজাগানিয়া নিবন্ধে, এমনকি চিত্রকলায়ও রবীন্দ্রনাথ চিরনবীন-চির অমর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন দার্শনিকও। তার ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তা-চেতনা শুধু নিজের শান্তি বা নিজের আত্মার মুক্তির জন্য ধর্ম নয়। মানুষের কল্যাণের জন্য যে সাধনা তাই ছিল তার ধর্ম। তার দর্শন ছিল মানুষের মুক্তির দর্শন। মানবতাবাদী এই কবি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বমানবতায়। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেই দর্শনকে অন্বেষণ করেছেন তিনি। তার কবিতা, গান, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার লেখনী মানুষকে আজও সেই অন্বেষণের পথে, উপলব্ধির পথে আকর্ষণ করে। রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের মনমানসিকতা গঠনের, চেতনার উন্মেষের প্রধান অবলম্বন। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ’ নামের বানানটিও আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পেয়েছি। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। এখনও প্রতিবছর রমনা বটমূলে রবীন্দ্রনাথের গানে গানে পহেলা বৈশাখ উদযাপন আমাদের জাতীয় জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। আমাদের জীবনের এমন কোনো বিষয় নেই, যেখানে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাই না। তার রচনাবলী আমাদের প্রেরণার শিখা হয়ে পথ দেখায়। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। ‘সং অব অফারিং’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রথম এশীয় হিসেবে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

তিনিই একমাত্র কবি, যিনি তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা (বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলংকা)। জীবনের শেষ পর্যায়ে চিত্রকর হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। আশি বছরের জীবন সাধনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জন্ম এবং মৃত্যুকে একাকার করে তুলেছিলেন অজস্র অমরতার শাশ্বত বার্তায়। সত্যি বলতে বাঙালির চেতনার রঙ স্পষ্ট হয়েছে রবিঠাকুরের আলোয়। তাইতো তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। আজকে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মাথাছাড়া দিয়ে উঠেছে সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতার বাণী এবং তার মতাদর্শ জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। রবীন্দ্রচর্চা তরুণ সমাজকে করে তুলতে পারে আরো মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে আলোচনাপর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার কামাল ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন। আলোচনা শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফারহানা চৌধুরী বেবীর পরিচালনায় বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টস পরিবেশন করবে নৃত্যালেখ্য ‘ষড়ঋতু’।

এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা আয়োজনে রবিঠাকুরের ৭৫তম প্রয়াণ দিবস পালন করবে। বিটিভিসহ বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল ও বেতারেও সম্প্রচার করা হবে বিশ্বকবির প্রয়াণ দিবসের নানা অনুষ্ঠান। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ রচনা।

বাংলা একাডেমি আয়োজন করেছে দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। শনিবার বিকেল ৪টায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আহমদ রফিক রচিত রবীন্দ্রজীবন (তৃতীয় খন্ড)-এর প্রকাশনা উৎসব হবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেবেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন অধ্যাপক শফি আহমেদ এবং অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন রবিবার বিকেল ৪টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে একক বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও রবীন্দ্রপুরস্কার-২০১৬ প্রদান করা হবে। রবীন্দ্রবিষয়ক একক বক্তৃতা করবেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী অধ্যাপক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এ বছর রবীন্দ্রপুরস্কার প্রদান করা হবে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন ও শিল্পী তপন মাহমুদকে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় ছায়ানটের রমেশচন্দ্র মিলনায়তনে নাচ, গান ও আলোচনার মধ্য দিয়ে কবিগুরুর প্রয়াণবার্ষিকী পালন করবে। রবীন্দ্রসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ একদিন আগে থেকেই শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় শাহবাগের শওকত ওসমান মিলনায়তনে শুরু করেছে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। শনিবার গান ও আলোচনার মধ্য দিয়ে এই আয়োজনের শেষ হবে।

এছাড়াও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো রবীন্দ্র প্রয়াণদিবস উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।

প্রসঙ্গত, ১২৬৮ সনের ২৫ বৈশাখ (১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি একাধারের কবি, নাট্যকার, কথাশিল্পী, চিত্রশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, অভিনেতা, ছোট গল্পকার ও ভাষাবিদ। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comment moderation is enabled. Your comment may take some time to appear.