আজ : ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News

রিয়েল হিরো

মহাসড়কের পাশেই ডোবা। তাতে পচা পানি। গা গুলিয়ে যাওয়া দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনায় পরিপূর্ণ। হঠাৎ একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেল তাতে। চারপাশে হই-হুল্লোড়। চিৎকার চেঁচামেচি। জীবন শঙ্কায় অন্তত অর্ধশত প্রাণ। নিশ্চিত মৃত্যু তাদের। সময় কম। উদ্ধার করতে গেলেই মৃত্যু ঝুঁকি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। অনেকেই এই মর্মান্তিক ঘটনাকে সাক্ষী করতে ভিডিও করছেন। ঠিক এই মুহূর্তে দেবদূত রূপে সেখানে হাজির হলেন পুলিশের এক কনস্টেবল। একে একে বের করে আনেন শিশুসহ ২০-২২ জনকে। বেঁচে যায় ডুবে যাওয়া বাসযাত্রীরা। যে যার মতো করে সেই দৃশ্য ধারণ করলেন। না, এটি কোনো নাটক বা সিনেমার দৃশ্য নয়। মামুলি এক পুলিশ সদস্যের বাস্তব জীবনের অনন্য কীর্তি। অসীম সাহসী, নির্ভীক, অকুতোভয়, মানবদরদী, প্রত্যুৎপন্নমতি- কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয় তার জন্য। তিনি পারভেজ মিয়া। কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের এক মামুলি কনস্টেবল। বাস্তবে দ্য রিয়েল হিরো। এদিকে পারভেজের এ কীর্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তার ছবিসহ ওইদিনের কর্মতৎপরতা ফেসবুকে দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। ইউটিউবে ভাইরাল হয় ভিডিও। মুহূর্তেই লাখ লাখ মানুষ সেটি শেয়ার করে। প্রশংসায় ভাসে পারভেজ। অপরদিকে এ অসীম সাহসিকতা ও তার মহত্বের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে মাত্র ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়ায় সমালোচনাও করেছেন অনেকে।
শুক্রবার মতলব এক্সপ্রেস পরিবহনের একটি বাস অর্ধশত যাত্রী নিয়ে চাঁদপুরের মতলবে যাচ্ছিল। সকাল ১১টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরীপুর বাসস্যান্ড এলাকায় এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে ময়লা পানির খাদে পড়ে যায় বাসটি। এ সময় পাশেই দায়িত্ব পালন করছিলেন হাইওয়ে পুলিশের কনস্টেবল পারভেজ মিয়া। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনা যখন আশপাশের সবাই দাঁড়িয়ে দেখছিলেন তখন সেই দুর্গন্ধযুক্ত ডোবার ময়লা পানিতে লাফ দেন পারভেজ মিয়া। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শুরু করেন উদ্ধার তৎপরতা। তাৎক্ষণিকভাবে ডুবন্ত বাসটির জানালার সব কাঁচ ভেঙে ফেলেন যেন যাত্রীরা সহজে বেরিয়ে আসতে পারে। এরপর নিজেই ডুবন্ত বাসটির ভেতরে প্রবেশ করে উদ্ধার করে আনেন সাত মাস বয়সী একটি শিশুকে। এরপর একে একে বের করে আনেন পাঁচ নারীসহ ১৫ যাত্রীকে। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসিকতায় বেঁচে যায় ডুবে যাওয়া বাসের অর্ধশত যাত্রী। ঘটনা সম্পর্কে পারভেজ মিয়া বলেন, বাসটি খাদে পড়ার খবর দেয় তাকে। তখন তিনি দৌড়ে ঘটনাস্থলে যান। দেখেন বাসটি আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। তখন কোনোদিক খেয়াল না করে আমি নিজেই মোবাইল মানিব্যাগ অন্যের কাছে দিয়ে নেমে পড়ি। দেখি, সবাই তাকিয়ে আছে। কেউ নামে না।’ পারভেজের এই সাহসিকতা দেখে স্থানীয়রাও উদ্ধারকাজে তৎপর হয়ে ওঠে। এরপর খবর পেয়ে উদ্ধারকাজে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সবার সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয় বাসটির সব যাত্রীকে। এই ঘটনায় সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়ায় কুমিল্লার হাইওয়ে পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে পারভেজ মিয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে পুলিশের সর্বোচ্চ পুরস্কারের জন্য পারভেজের নাম সুপারিশ করবেন বলেনও জানান। এছাড়া স্থানীয় পেন্নাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ৫ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন।
কনস্টেবল পারভেজের এই সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার খবর সামাজিক মাধ্যমে মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। প্রশংসায় ভাসেন তিনি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও প্রশংসা করেন। তাকে অভিবাদন জানান।
পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক তার ফেসবুক ওয়ালে পারভেজের উদ্ধার তৎপরতার চারটি ছবি দিয়ে লেখেন- (অভিবাদন ও স্যালুট হে জাতীয় বীর) আশেপাশে শ’ শ’ উৎসুক মানুষ। ডোবার পচা, দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে দুর্ঘটনা কবলিত অর্ধডুবন্ত যাত্রীবাহী বাস। প্রত্যেকেই জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ডোবার পচা পানিতে বাসের মধ্যে আহত অবস্থায় আটকা পড়ে আছেন। ডোবার পচা, দুর্গন্ধযুক্ত পানি দেখলে যে কারো গা ঘিনঘিন করবে এমনটাই স্বাভাবিক। এখানেও মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ। দুর্ঘটনার সংবাদ পুলিশের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসেছিল অন্যান্য সহকর্মীসহ কনস্টেবল পারভেজ। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় এলাকাবাসী এবং ফায়ার সার্ভিসও। ডোবার পচা, দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে নেমে একে একে বের করে আনেন সাত মাস বয়সী শিশু, নারীসহ বাসের সকল যাত্রীকে। প্রাণে বেঁচে যায় বাসের ৩৫ জন যাত্রীর সকলেই। পুলিশ কনস্টেবল পারভেজের মতো কিছু মানুষ এখনো পৃথিবীতে আছে বলেই মানবতা টিকে আছে। স্যালুট জানাচ্ছি বাংলাদেশ পুলিশের এ গর্বিত সদস্যকে। কনস্টেবল পারভেজের এ কর্মতৎপরতায় গর্বিত হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রিজিয়ন। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশও গর্বিত। গর্বিত বাংলাদেশ পুলিশ। স্যালুট পারভেজ তোমায়। তোমার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা।’
সাপ্তাহিক সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা লেখেন- ‘নিজের জীবন তুচ্ছ করে মানুষের জীবন বাঁচানো পুলিশ কনস্টেবল পারভেজ আপনাকে সালাম বা অভিনন্দন জানিয়ে পুরোটা বোঝানো যায় না। দাউদকান্দি থানার এই পুলিশ কনস্টেবল মানুষের প্রতি মমতার এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন। দায়িত্ব নিয়েই বলছি, পুলিশ বাহিনীতে এমন পারভেজ একজনই নয়, অনেক আছেন। দুর্ভাগ্য এই যে, তারা সংবাদ শিরোনাম হন না, সংবাদ শিরোনাম হন অপকর্মকারীরা। এই দায় গণমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে লাভ নেই। কেন এমন হয়, তা নিয়ে চিন্তা ও প্রতিকার বিষয়ে ভাবতে হবে পুলিশ যারা পরিচালনা করেন তাদের। একজন পারভেজের এমন সাহসিকতার পুরস্কার ১০/১৫ হাজার টাকা নয়। তার জন্য কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকার পুরস্কারের ব্যবস্থা করেন। তার বাকি জীবনটা নিশ্চিত করে দেন। দায়িত্ব দেন, কনস্টেবল হিসেবে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ নেই তার। দায়িত্ব-স্বীকৃতি পেলে আরও অনেক কিছু করে দেখাতে পারবেন তিনি। তাকে দেখে শিখবেন অনেকে। পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়া ঘুষমুক্ত করলেও অনেক পারভেজের সন্ধান পাওয়া যাবে।’
তাই এই পোস্টে সিকদার গিয়াসউদ্দিন নামে প্রবাসী লিখেছেন- ‘ইউরোপ, আমেরিকা হলে এটি বিশ্ব সংবাদ হতো। তদুপরি সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন কর্তৃক পুরস্কৃত করা ছাড়াও তাকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ কিংবা বিভিন্ন সেমিনারে, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে তার অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানাতো। অর্থনৈতিক সুবিধা সহকারে বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হতো।’
ইমরান মোহাম্মদ তালুকদার (ইমরান) নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকের এক পেজে দেয়া এক পোস্টের কমেন্ট বক্সে তিনি লেখেন- ‘হাজারো সালাম ভাই, এই সাহসিকতার জন্য অনেক যাত্রীর প্রাণ বাাঁচানোর জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে ৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেবো। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এই টাকা পৌঁছে দেবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comment moderation is enabled. Your comment may take some time to appear.