আজ : ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News

সরকার অসহায় নূরু মণ্ডলের ‘রাজ্যে’

দৌলতদিয়া ঘাটে চলছে এক ‘রাজার শাসন’। অনেক ‘পাইক-পেয়াদা’ আছে তার। রাজাই নড়ে না সেখান থেকে, তার হুকুম নড়বে কেমন করে? তার হুকুমে পরিবহন চালকদের কেউ নিজের হাতে ঘাটের টিকিট কাটেন না। রাজার পাইক-পেয়াদারাই টিকিট কেটে দেয়। প্রতিদিন গড়ে হাজার খানেক ট্রাক এই ঘাট দিয়ে ফেরিতে ওঠে। টিকিট কেটে দেওয়ার বিনিময়ে রাজা ৮০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি আদায় করেন। এইভাবে দৈনিক গড়ে ১৫ লাখ টাকা ওঠে। মাসে ওঠে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। আর তা সরাসরি চলে যায় রাজার ‘কোষাগারে’। এই রাজার নাম নূরুল ইসলাম মণ্ডল ওরফে নূরু মণ্ডল। রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তিনি। যদিও তার ভাষ্যমতে, এসবই ‘নির্জলা মিথ্যা’, তার সুনাম নষ্ট করার জন্য ‘অপপ্রচার’।

ডাকাতিয়া গ্রামের এলেম মণ্ডলের ছেলে নূরু মণ্ডল এক সময় ছিলেন দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ফেরিওয়ালা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর সুযোগ হয়নি তার। কিন্তু ‘কর্মগুণে’ এখন তিনি ঘাটের ‘রাজা’। অভিযোগে প্রকাশ, এলাকার স্থানীয় এমপিসহ ওপর মহলের সঙ্গে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তার এ রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্রিয় কয়েকটি দালাল-ক্যাডার বাহিনী। সমকালের এই প্রতিবেদক সরেজমিন ঘুরে দেখতে পান, ট্রাকচালক অথবা তার সহকারী নির্ধারিত মূল্যের দ্বিগুণ টাকা তুলে দিচ্ছেন দালালের হাতে। কিছুক্ষণ পরে সে ফিরে আসছে টিকিট নিয়ে। এরপর মিলছে ওই ট্রাকের ছাড়পত্র। এই দালালরা সবাই নূরু বাহিনীর। তাদের এড়িয়ে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পাড়ি দেওয়া দুষ্কর। তাদের এড়িয়ে নিজেরা টিকিট সংগ্রহ করতে গেলে হতে হয় অমানুষিক নির্যাতনের শিকার। শুধু পরিবহন শ্রমিকরা নন, খোদ বিআইডবি্লউটিসির কর্মকর্তাও তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

দৌলতদিয়া ফেরিঘাট দালাল-ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা স্বীকার করে বিআইডবি্লউটিসির উপমহাব্যবস্থাপক শেখ মো. নাসিম সমকালকে বলেন, ‘দালালদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান চালাতে পারি না। কারণ আমাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একটি অভিযান চালিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের কর্মচারীরা হাজার চেষ্টা করেও ট্রাক ড্রাইভারদের সরাসরি টিকিট কাটার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারছে না। ড্রাইভাররা তো আমাদের কাউন্টারেই আসতে পারে না!’

উপমহাব্যবস্থাপক নাসিম বলেন, ‘সরাসরি টিকিট দেওয়ায় আমাদের কর্মকর্তা আবুল বাশারকে দালালরা মেরে হাত-পা ভেঙে দিয়েছিল। তখন থেকে তাদের বিরুদ্ধে কেউ আর কথা বলে না।’ এই দালালদের কারা নিয়ন্ত্রণ করছে জানতে চাইলে বিআইডবি্লউটিসির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না, আপনারা অনুসন্ধান করে দেখেন।’

তবে দৌলতদিয়া ঘাটের বিআইডবি্লউটিসির ম্যানেজার শফিকুল ইসলাম (বাণিজ্য) বলেন, ‘রাজবাড়ীর বর্তমান পুলিশ সুপার আসার পর দালালদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমেছে। তাদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলাও করা হয়েছে।’ গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পঙ্কজ ঘোষ সমকালকে বলেন, ‘ঘাট এলাকায় দালালদের তাড়াতে অভিযান চালিয়ে ২০-২৫ জনকে আটক করেছিলাম। কয়েকজনকে দণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। প্রায়ই আমরা সেখানে অভিযান চালিয়ে থাকি।’

নূরু মণ্ডল একাই নিচ্ছেন প্রতি মাসে কোটি টাকা :অনুসন্ধানে দেখা যায়, দৌলতদিয়ার চারটি ফেরিঘাট দিয়ে প্রতিদিন সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার গাড়ি পারাপার হয়। এর মধ্যে মাল বোঝাই ট্রাক চলাচল করে দেড় হাজারের বেশি। ফেরি পারাপারের ক্ষেত্রে বিআইডবি্লউটিসির নির্ধারিত ভাড়া ছোট ট্রাকের ক্ষেত্রে এক হাজার ৬০ টাকা এবং বড় ট্রাকের ক্ষেত্রে এক হাজার ৪৬০ টাকা। কিন্তু দালালরা ছোট ট্রাকের ক্ষেত্রে এক হাজার ৮০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা এবং বড় ট্রাকের ক্ষেত্রে দুই হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করে। এভাবে একেকটি ট্রাক থেকে দালালরা অতিরিক্ত এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা গাড়িপ্রতি আদায় করে নিচ্ছে। গড়ে ট্রাকপ্রতি এক হাজার টাকা হিসাবে নূরু মণ্ডলের বাহিনী প্রতিদিন আদায় করছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। প্রতি মাসে এ বাহিনী চাঁদা তুলছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা। বিআইডবি্লউটিসি, ট্রাফিক পুলিশসহ বিভিন্ন সেক্টরের কয়েক অসাধু কর্মকর্তাও এই চাঁদাবাজির টাকার ভাগ পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। নূরু মণ্ডল একাই প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রায় কোটি টাকা।

কে কী করছে নূরু বাহিনীতে :অনুসন্ধানে জানা গেছে, চেয়ারম্যান নূরু মণ্ডলের দালাল-ক্যাডাররা চাঁদাবাজি করছে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের গরু এবং কাঠ বহনকারী ট্রাকগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন গোয়ালন্দ উপেজলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম মণ্ডল। তিনি নূরু মণ্ডলের চাচাতো ভাই এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী। মাছ বহনকারী ট্রাকগুলো থেকে চাঁদাবাজি করছেন দৌলতদিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জুলহাস মোল্লা। কাঁচামালের ট্রাক নিয়ন্ত্রণ করছেন মো. টোকন সর্দার, ফলের গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করেন মো. মোস্তফা মণ্ডল, কাভার্ডভ্যান নিয়ন্ত্রণ করেন আতিকুজ্জামান সেন্টু, তিনি উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ছোট পিকআপ নিয়ন্ত্রণ করেন ফারুক হোসেন মৃধা। তাদের প্রত্যেকের অধীনে শতাধিক দালাল-ক্যাডার টিকিট কাটার নামে দ্বিগুণ টাকা ওঠাচ্ছে।

অভিযুক্তদের ভাষ্য :তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম মণ্ডল সমকালকে বলেন, ‘আমি ট্রাকের দালালদের সঙ্গে জড়িত নই। নদীভাঙা এলাকার লোকজন এখানে দালালি করে। আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা।’ তিনি দাবি করেন, শত্রুতা করে তার সুনাম নষ্ট করার জন্য এসব বলা হচ্ছে।

অভিযোগ অস্বীকার করে জুলহাস মণ্ডল বলেন, ‘দালাল তো ভাই জোর করে কিছু করে না। ট্রাকের ৭০ জন মালিক এক হয়ে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন। আমার নিজের পাঁচটি ট্রাক। সেগুলোর জন্য ৫-৬ জন কাজ করে।’ বেশি টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সরকারি একটা কাগজ নিতে বেশি টাকা দিতে হয়, এখানেও দিতে হচ্ছে।’

ভুক্তভোগীদের প্রতিক্রিয়া :এ ব্যাপারে মোবারক হোসেন নামে এক ট্রাকচালক বলেন, ‘ঘাটে প্রতিদিন যেসব ট্রাক পার হয়, সেগুলোর মধ্যে এমন একটাও নাই, যেটার ড্রাইভার বা হেলপার নিজেরা টিকিট কেটে ফেরিঘাট পার হয়েছে। নূরুর দালালদের ছাড়া টিকিট কাটা যায় না। তারা অতিরিক্ত টাকা নেয়। বিআইডবি্লউটিসির লোকজনও সরাসরি টিকিট দেওয়ার সাহস পান না।’ বিআইডবি্লউটিসিতে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘সরাসরি টিকিট দিয়ে মার খাব না কি? পুরো ঘাট তো নূরু মণ্ডলের নিয়ন্ত্রণে।’

খুলনা থেকে মালবাহী ট্রাক নিয়ে এসেছেন রফিকুল ইসলাম। যাবেন সাভারের আশুলিয়ায়। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘এটা চাঁদাবাজি নয়_ ডাকাতি। টিকিট কেটে আমরা ফেরিঘাট পার হব। অথচ টিকিট কাটতে পারি না। দ্বিগুণ টাকা নিয়ে টিকিট কেটে দেয় দালালরা।’ ট্রাকচালক আবদুল হক বলেন, ‘১০ বছর ধরে এই পথ দিয়ে গাড়ি চালাই। একদিনও নিজে টিকিট কাটতে পারিনি। শুধু আমি কেন, এমন কোনো ট্রাকচালক নেই, যে বলতে পারবে নিজে টিকিট কেটে ফেরি পার হয়েছে।’ কার কারণে এমন হচ্ছে তা জানতে চাইলে নীরব থাকেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comment moderation is enabled. Your comment may take some time to appear.