আজ : ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News

হিন্দু নারীরা’ ‘বিবাহ-বিচ্ছেদের অধিকার চান’

বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক আইনে সংস্কার না হওয়ায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই।
দেশটির মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নির্যাতনের নানান অভিযোগে হিন্দু নারীদের মধ্যে স্বামী থেকে আলাদা থাকার প্রবণতা বাড়ছে।
বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার না থাকায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। বিধবা নারীদের সম্পত্তির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও এখন উঠছে।
ঢাকার লক্ষীবাজার এলাকায় হিন্দু এক প্রেমিক যুগল তাদের পরিবার রাজি না হলেও ঢাকঢোল বাজিয়ে শাস্ত্র মেনে বিয়ে করেছিলেন। পরে পরিবার মেনে নিয়েছিল।
কিন্তু কয়েকমাসের মধ্যেই সেই সংসারে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় সন্তান নেয়া না নেয়ার প্রশ্নে। স্ত্রী সন্তান নেয়ার ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে থাকলে তাঁকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়।

সেখানে কন্যা শিশু জন্ম দেয়ার পর সেই নারী স্বামীর বাড়িতে ফেরত এসে আশ্রয় পাননি।
সেই থেকে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঢাকার লক্ষীবাজার এলাকায় তিনি স্বামী থেকে আলাদা হয়ে কন্যা নিয়ে বসবাস করছেন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলছিলেন, তাদের ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যবস্থা না থাকায় আমৃত্যু তাঁকে একা থাকতে হবে, এটা মেনে নেয়া ছাড়া তাঁর কোনো উপায় নেই।

“আমি স্বামীকে ডিভোর্স দিতে পারছি না। যদিও সালিশের মাধ্যমে আলাদা হওয়ায় তিনি আমাকে ভরনপোষণের জন্য মাসে নয় হাজার টাকা দিচ্ছেন। কিন্তু এটাতো জীবন নয়। আমার মেয়ে আমাকে বলে,আমার আব্বু কেনো সাথে থাকে না? স্কুলে বন্ধুদের সকলের আব্বু আছে। মেয়ের এমন কথায় আমার খুব কষ্ট হয়।”
একবার বিয়ে হলে যেহেতু বিচ্ছেদের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেই সূত্র ধরে নারীদের দ্বিতীয় বিয়ে করারও অধিকার নেই।
অন্যদিকে হিন্দু পুরুষদের স্ত্রীর অনুমতি না নিয়েই একাধিক বিয়ে করার সুযোগ রয়েছে।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত নির্যাতিত নারীদের আইনী সহায়তা দেন। তিনি বলেছেন,অনেক নারী নির্যাতিত হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে স্বামী থেকে আলাদা থাকেন। কিন্তু এই ব্যবস্থার আইনগত কোনো ভিত্তি থাকে না।
তিনি আরও বলছিলেন, “ধর্ম অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন থাকতে হবে আমৃত্যু। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শাস্ত্র বা মন্ত্র তাদের জায়গায় আছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে, ঘরে স্বামী-স্ত্রীর যুদ্ধও আছে।
স্ত্রী স্বামীকে ছেড়ে একা থাকছে। এই সুযোগে স্বামী আরেকটা বিয়ে করছে। এটাই বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত নির্যাতিত নারীদের আইনী সহায়তা দেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র নির্যাতিত নারীদের অভিযোগ নিয়ে সে ব্যাপারে আইনী সহায়তা দিয়ে থাকে।
সংগঠনটি বলছে, তাদের অভিযোগ কেন্দ্রে এখন হিন্দু নারীদের অভিযোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এই বিভাগের প্রধান নীনা গোস্বামী বলেছেন, “হিন্দু নারীরা মূলত ঘরে নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে স্বামী থেকে আলাদা থাকার আবেদন নিয়ে আসেন।”

“তখন সালিশ-সমঝোতার মাধ্যমে ভরনপোষণের অর্থ নিয়ে তারা আলাদা হচ্ছেন। বিয়ের কিন্তু সমাপ্তি ঘটছে না। সেখান থেকে তাদের বেরুবার কোনো পথ নেই। হিন্দু নারীরাএখন বিবাহ-বিচ্ছেদরে অধিকার চাইছেন”-বলেছেন নীনা গোস্বামী।
যখন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে বা জীবন আটকে যাচ্ছে,তখন অনেক নারী ধর্ম বা শাস্ত্র সবকিছু এড়িয়ে অন্তত স্বামী থেকে আলাদা থাকছেন বা থাকার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু বড় অংশই চোখ বুঁজে সব মেনে নিচ্ছেন। আর সেখানে বন্ধনের চেয়ে জীবন টিকিয়ে রাখাই মুল বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন।
হিন্দু নারীদের সম্পত্তির ওপর কোনো অধিকার নেই। বাবার ঘরে ছেলেদের মতো মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ পায় না। বিয়ের পর স্বামীর ঘরেও সম্পত্তির মালিক হতে পারেন না। বিধবা হলে আশ্রিত হয়ে যান।

বাংলাদেশে হিন্দু নারীদের দ্বিতীয় বিয়ের অধিকার না থাকলেও পুরুষদের স্ত্রীর অনুমতি না নিয়েই একাধিক বিয়ে করার সুযোগ রয়েছে
প্রায় দুই দশক আগে আকস্মিক অসুস্থতায় স্বামী মারা যায় ফরিদপুর জেলা শহরের নীলটুলী এলাকার সুপ্রিয় দত্তের। তখন তাঁর কোলে দুই শিশু সন্তান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে লেখাপড়া করা এই নারী ফরিদপুরে একটি কলেজে শিক্ষকতা করার সুবাদে আর্থিকভাবে সমস্যায় তাঁকে পড়তে হয়নি।
তবে বিধবা হওয়ার পর থেকে তিনি যেনো শ্বশুরবাড়িতে আশ্রিত আছেন, এমনটাই তাঁর মনে হয়।
সুপ্রিয় দত্ত বলছিলেন, “স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আমি শ্বশুর বাড়িতে আছি। আমার একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে। আমার ছেলে আছে বলে শ্বশুর বাড়িতে থাকতে পারছি। কিন্তু সম্পত্তির ওপর আমার কোনো মালিকানা নেই।”

“বাবার বাড়িতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমার নিজের বলে কোনো সম্পত্তি নেই। শ্বশুর বাড়িতে আমি আশ্রিত বলতে পারেন।”
তিনি মনে করেন, এ ধরণের ব্যবস্থায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আসলে এর সংস্কার প্রয়োজন।
বিধবা নারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন আসে কারণ আইনী কোনো সুরক্ষা নেই, তাদের আবার বিয়ে করারও সুযোগ শাস্ত্রে নেই। তখন তাদের অসহায় পরিস্থিতি মেনে নেয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না।

রানা দাশগুপ্ত মনে করেন, এমন ব্যবস্থা পুরো সমাজকেই অসহায় করে রেখেছে।
“বিধবা নারীদের একটা বড় অংশই চোখের জল ফেলে বাকি জীবনটা পার করেন। আইনজীবী হিসেবে আমার কাছে অনেকে সহায়তা চান। কিন্তু আইনগতভাবে আমার কিছুই করার থাকে না।”
“তখন সন্তানদের ডেকে তাদের ময়ের সাথে সাথে ভাল আচরণ করার অনুরোধ করে দায়িত্ব শেষ করি”-বলছিলেন রানা দাশগুপ্ত।
হিন্দু আইন নামের ব্রিটিশ আমলের একটি আইন আছে। তাতে বিবাহ বিচ্ছেদ, পরিবার, বা সম্পত্তির মালিকানা প্রশ্নে ঐ ধর্মের শাস্ত্রের ব্যবস্থাগুলোই রয়েছে।
ভারতে এবং নেপালে আইনে অনেক সংস্কার হয়েছে। হিন্দু নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন অথবা বিধবা হলে তারা বিয়ে করার অধিকার পেয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা নীনা গোস্বামী বলছেন, তাদের অভিযোগ কেন্দ্রে এখন হিন্দু নারীদের অভিযোগের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশে শুধু নিবন্ধনের বিষয়ে একটি আইন হয়েছে ২০১২ সালে আওয়ামী রীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে। সেটিও বাধ্যতামুলক করা হয়নি।
তখন আইনমন্ত্রী ছিলেন শফিক আহমেদ। তিনি মনে করেন, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সম্পত্তির মালিকানাসহ হিন্দু নারীদের অধিকারের প্রশ্নে আইন প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।

কিন্তু কোনো উদ্যোগ নিলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ তোলা হতে পারে, এমন ভয় সরকারের মধ্যে কাজ করে বলে তাঁর ধারণা।
এনজিওদের একটি ফোরাম একটি আইনের খসড়া তৈরি করে সরকারের কাছে দিয়েছে।
কিন্তু হিন্দুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে, এমন সংগঠনগুলোর নেতারা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়ে আছেন।
বিবাহ নিবন্ধন আইনটি বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারেও তাদের কোনো আগ্রহ নেই।

রানা দাশগুপ্ত বলছিলেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদেরকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি খসড়া তৈরি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের কোনো উদ্যোগ নেই।
তিনি বলছিলেন, “এখনকার পরিস্থিতি হলো, সংখ্যালঘুদের ওপর সামগ্রিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ উঠছে। তারা অস্তিত্বের সংকটে আছে। ফলে এখন অস্তিত্ব রক্ষা করবে নাকি অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়ে কাজ করবে। এসব প্রশ্নে একটা বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেজন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না।”

হিন্দু নারীরা তাদের অসহায় পরিস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য হলেও সংস্কার চাইছেন ।
রানা দাশগুপ্ত যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর সামগ্রিকভাবে নির্যাতনের অভিযোগের কথা বলে নারীদের অধিকার প্রশ্নে উদ্যোগের বিষয় এড়িয়ে গেলেন।
তাদের বেশিরভাগে নেতাই এখনও এমন আইনের বিপক্ষে রয়েছেন।

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিম চন্দ্র ভৌমিক বলছিলেন, বিয়ে বা পরিবার নিয়ে ধর্মের স্বীকৃত বিধান চলে আসছে দীর্ঘ সময় ধরে। সেজন্য তাতে সংস্কারের ব্যাপারে তাদের সমাজে জড়তা আছে বলে তিনি মনে করেন।

একইসাথে তিনি বলেছেন, বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হলে তখন ঠুনকো বিষয়েই পরিবারগুলোর বন্ধন ভেঙ্গে যেতে পারে। সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এমন ভয়ও তাদের অনেকের মধ্যে রয়েছে।

তবে, হিন্দু নারীদের অধিকারের প্রশ্নে তাদের নেতাদের একটা বড় অংশ পুরোনো ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে থাকতে চাইছেন। তারা এখনও বিভক্ত। কবে তারা একমত হতে পারবেন, সেটা তারাই বলতে পারেন না ।

নারীরা কিন্তু অসহায় পরিস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য হলেও সংস্কার চাইছেন। তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। কিন্তু কে নেবে সেই উদ্যোগ সেটাই এখন প্রশ্ন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comment moderation is enabled. Your comment may take some time to appear.