আজ : ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News

আইএস যেভাবে আমার ব্রেনওয়াশ করে

পেশায় স্কুলশিক্ষক ও বেবিসিটার, ২৩ বছর বয়সী অ্যালেক্স যেদিন তার টুইটার ফলোয়ারদের জানান যে তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন সেদিন তিনি উত্তেজনায় কাঁপছিলেন। এর আগে কয়েক মাস ধরেই তিনি অনলাইনে নতুন একদল বন্ধুর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছিলেন। জীবনে যত বন্ধু পেয়েছেন এরা তাদের সবার চেয়ে অনেক বেশি যত্নবান ছিল। এরা তাকে মুসলিম হওয়ার মানে কী সে সম্পর্কে শেখাত। এরপর তারা প্রায়ই তাকে ইসলামিক স্টেট এবং কী করে সংগঠনটি সিরিয়া ও ইরাকে নিজেদের জন্য একটি আবাসস্থল তৈরি করছে এবং কী করে ‘পবিত্রজনরা (দ্য হলি)’ সেখানে ‘ঈশ্বরের (আল্লাহ)’ আইন অনুযায়ী জীবনযাপন করতে পারবে সেসব বলত। এদের একজনের নাম ফয়সাল। সারাক্ষণই তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করত। প্রতিদিন টুইটার, স্কাইপ ও ই-মেইলে সে তার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা করত। এ সময় সে খুবই যত্নের সঙ্গে তাকে ইসলামী ধর্মবিশ্বাসের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জানাত। কিন্তু যেদিন অ্যালেক্স তাকে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বললেন যে, তিনি ওয়াশিংটন রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে তার দাদার বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটি মসজিদের সন্ধান পেয়েছেন সেদিন থেকেই তার অনলাইন বন্ধু ফয়সাল হুট করেই চুপসে যান। অনলাইনেইর ওই একদল মুসলিম ছাড়া অ্যালেক্স বাস্তব জীবনে আর কোনো মুসলিমের দেখা পাননি। মসজিদের কথা বলার পর থেকে অনলাইন মুসলিম ফয়সাল তাকে বলতে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদেরকে হত্যা করা হচ্ছে। মুসলিম হয়েছে জানতে পারলে অ্যালেক্সকেও সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করা হতে পারে। আর এখন থেকে অনলাইনে তাদের আলাপ-আলোচনার বিষয়গুলোও গোপন রাখার পরামর্শ দেন ফয়সাল। এমনকী নিজের পরিবারের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা না বলার পরামর্শ দেয় ফয়সাল। ফয়সালের পরামর্শে দুই ধরনের জীবনযাপন শুরু করেন অ্যালেক্স। তিনি গির্জায় পড়ানো অব্যাহত রাখেন। কিন্তু রেডিওতে এখন আর তিনি খ্রিষ্টানদের জনপ্রিয় সংগীতের চ্যানেল কে-লাভ শোনেন না। এর পরিবর্তে তিনি আইফোনে আইএসের গান শোনেন এবং জঙ্গিদের সঙ্গে জীবনটা কেমন হবে তা নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখা শুরু করেন। অ্যালেক্স বলেন, ”আমার মনে হচ্ছিল আমি ঈশ্বর ও খ্রিষ্টান ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি। তবে অনলাইনে নতুন নতুন বন্ধু পেয়ে আমি কিছুটা উত্তেজিতও ছিলাম।” এ সময় ইসলামিক স্টেটের আদর্শ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে তীব্র নিন্দার ঝড় বইতে শুরু করে। এর পরেও পশ্চিমা দেশ থেকেও অনেককে তাদের দলে ভেড়ানো সম্ভব হয়। আইএসের দলে ভেড়ানো লোকরা পশ্চিমাদের প্রোপাগাণ্ডাতে পাত্তা দিতে মানা করে। এই বছরের জানুয়ারিতে, কমপক্ষে এক শ মার্কিনিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ইরাক, সিরিয়ার জিহাদি গ্রুপে যোগ দেয় তারা। তাদের মাঝে, বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ থেকে ছিল আরও চার হাজার মানুষ।   সোশলা মিডিয়াতে আইএস তাদের লোকদের দলে ভেড়াতে শুরু করল। তাদের সংখ্যা বাড়তে লাগল চককপ্রদভাবে। সামাজিক গণমাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা সেই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অপারেশন চলতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে, অনেক আইএস স্বেচ্ছাসেবী, সমর্থক আইএসের খবর ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে লিপ্ত থাকত। আলেক্সের অনলাইন গ্রুপটি জড়িত ছিল ডজনখানেক ফেইক অ্যাকাউন্টের সাথে। আর কিছু মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা হতো যারা আইএসের সাথে আছে। আলেক্সের গ্রুপটি প্রায় ছয় মাস এক হাজার ঘণ্টা ধরে কাজ করেছিল। আইএস তাদেরকে অর্থ দিত। চকলেট দিত। তাদের কাজে ভূয়সী প্রশংসা করত। আইএস সদস্যর সংখ্যাবৃদ্ধিতে আরও নিজেকে কাজে লাগাতে বলা হতো। একজন খ্রিষ্টান হিসেবে অ্যালেক্সকে অনেক পুরস্কৃত করা হয়েছিল, তাকে আইএসে ভেড়ানোর উদ্দেশ্যে। অ্যালেক্সও নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন আরও কত উদারভাবে আইএসের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা যায়। নিঃসঙ্গরা বিপথে যায় যেভাবে : অ্যালেক্স শহরের খুব কাছেই থাকত। তার দাদা-দাদুরা চাইত নিরিবিলি পরিবেশে থাকতে। কিন্তু অ্যালেক্স চাইত কোনো দলের মাঝে থাকতে। তাদের কাছেই অ্যালেক্স ছোট থেকেই বেড়ে উঠেছে। তার বয়স যখন সবে ১১ বছর। তার মা অতিরিক্ত ড্রাগ সেবনে আসক্ত। তাকে রাখা হয়েছিল পুনর্বাসনকেন্দ্রে। একদিন হঠাৎ তার ফোন ১৯ আগস্ট সিএনএন লাইভ অ্যালার্টে কেঁপে উঠল। জেমস ফয়েলি নামে এক আমেরিকান সাংবাদিকের মাথা কেটে ফেলা হয়েছে। তা সম্প্রচার করছে সিএনএন। আইএস নামে যে এমন ভয়ংকর কিছু আছে, তা আগে জানা ছিল না অ্যালেক্সের। সেই দুর্বিষহ হত্যার দৃশ্য মনে গেঁথে গেল। অতি আগ্রহের সাথে আরও বেশি আইএস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হলো অ্যালেক্স। টুইটারে প্রবেশ করে দেখতে চাইল আইএস সম্পর্কে আর কি জানা যায়। ”আমি এমন কাউকে খুঁজছিলাম তাঁরা কি করা জানার জন্য। কেন তাঁরা এসব কাজ করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। অনলাইনে তাঁদেরকে খুঁজে পাওয়া তেমন কঠিন কাজ ছিল না।” অ্যালেক্স সেই মুহূর্তে ঘাবড়ে গেল। যিনি কি না আইএসের কর্মকাণ্ডের জন্যে চিহ্নিত সেই অ্যালেক্সের প্রশ্নের জবাব দেয়। ”তাঁরা যখন দেখল আমি আইএস সম্পর্কে জানার জন্য অনেক বেশি কৌতুহলী। তখন তাঁরা খুব বিনয়ের সাথে আচরণ করতে লাগল। তাঁরা জানতে চাইল আমার সম্পর্কে। আমার পরিবার সম্পর্কে। আমি কোথায় আছি। আমি জীবনে কি করতে চাই।” পরিচয়ের একপর্যায়ে তাকে জানানো হলো, তিনি আইএসের একজন যোদ্ধা মনজের হামাদ। সিরিয়ার কাছে দামেস্কে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁরা অনালাইনে চ্যাট করতে লাগলেন। ইসলাম সম্পর্কে ধারণা দিতে লাগলেন। আইফোনে ইসলাম হাব নামে আপ্লিকেশনটি ডাঊনলোড করতে বলেন। প্রতিদিন হাদিস সম্পর্কে নোটিফিকেশন আপডেট দেয়। মনজের অ্যালেক্সের কথা মন দিয়ে শুনতো। দিনের প্রায় সময় তখন অনলাইনে থাকতো অ্যালেক্স। সারাদিন আইফোন কেবল মেসেজ, নোটিফিকেশন আপডেট হতে লাগল। অ্যালেক্স কৌশলে মাঝে মাঝে জানতে চাইতো কিভাবে জিহাদিরা গলা কেটে মানুষ হত্যা করে। কিন্তু অ্যালেক্সের মনে তখন আইএসের প্রভাব এমনভাবে মোহাবিষ্ট করতে লাগলো। তখন  নিজের মনে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেল যে এগুলো মিডিয়ার সৃষ্টি। অ্যালেক্স আল্লাহ, যিশু, বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের নিয়ে পড়াশোনা শুরু করল। চার্চের ফাদারের সাথে ক্রিশ্চিয়ান প্রিনসিপাল নিয়ে কথা হলো। তর্ক বাঁধল।  কলেজ ছেড়ে দেওয়ার পর, অ্যালেক্স কিছুদিন ডে কেয়ারে কাজ করল। শর্ত ভঙ্গের কারণে চাকরি ছেড়ে দিল অ্যালেক্স। ফয়সালের সাথে অনলাইন কথোপকথনে এক মোহনীয় কথার জাদুর ফাঁদে পড়ে যায়। অ্যালেক্সের মনে গেঁথে যায় কথাগুলো। ক্রিসমাস ডে যতই কাছে আসতে লাগল অ্যালেক্স নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। ফয়সাল তাকে কলেমা পড়ায়- আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নাই। মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল। ধর্মান্তরিত হয়ে অ্যালেক্স হয়ে যান শাহাদা। টুইটারে যখন টুইট করে তখন অনেকে বিশ্বাস করতে পারেনি। হিজাব পরতে আরম্ভ করে। ফয়সাল ও তার কিছু সহযোগীকে পরিচয় করিয়ে দেয়। আজকে থেকে তাঁরা ভাই-বোন। ধর্মান্তরিত শাহাদা টুইট করে, ”অনেকে মনে করছেন আমি স্পাই হিসেবে কাজ করছি। আমি বলতে চাই আমি ৯২% নির্ভেজাল সত্য আমি ২৮ ডিসেম্বর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি। এখন থেকে আমার নাম শাহিদা।” একদিন অ্যালেক্সের দাদিমা খুব ভোরে উঠে দেখেন অ্যালেক্স জেগে আছে। ঘুমায়নি। সেই মার্চ মাস থেকে দাদুর সাথে তর্ক করত অ্যালেক্স। একদিন খুব সকালে অ্যালেক্সে দাদিমা আইএসের সদস্যদের সাথে অনালাইনে মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করেন। তবে অনেক চেষ্টা চালালেও আইএসের কারো সাথে যোগাযোগ করার সম্ভব হয়নি। তারপর, অ্যালেক্সের কম্পিউটার, ট্যাব, ফোন জব্দ করল দাদিমা। আইএস আবার তার দাদিমার সাথে কোনো একভাবে যোগাযোগ করল। দাদিমা কে সালাম দিল। দাদিমা প্রতি উত্তরে জানাল, ”অ্যালেক্সকে আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা কি করে মনে করলে নিশ্চিত বিপদ জেনে এমনাবস্থায় আমি অ্যালেক্সকে তোমাদের কাছে তুলে দিব। কি মনে করো তুমি নিজেকে? যেখানে, ২৪ বছর খ্রিষ্টান আদর্শে অ্যালেক্সকে গড়ে তুলেছি সেখানে তুমি তাকে ব্রেনওয়াশ করে তোমাদের দলে ভেড়াতে চাইছ।” ফয়সাল কিছুক্ষণ পর উত্তর দিল, ”আমি বুঝতে পেরেছি আপনি উগ্র মুসলিম বোঝাতে কি বলতে চাইছেন। আমার অনুরোধ রইল ফক্স চ্যানেলের নিউজকে বিশ্বাস করবেন না। আমরা সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাস করি না। আমরা এমন কোনো কাজ করি না যা আমার বন্ধুদের জন্য ক্ষতিকর কিংবা অবৈধ।” তার পরেও আইএসের নানা ভয়ংকর তথ্য জেনে যায় অ্যালেক্স। আইএসের সঙ্গে যোগাযোগের যাবতীয় মাধ্যম যেমন টুইটার, ইমেইল ও স্কাইপের পাসওয়ার্ড অ্যালেক্স এক পর্যায়ে তার দাদীকে দিয়ে দেয়। তিনি অ্যালেক্সের সব সামাজিক  মাধ্যমের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে ফেলেন। অ্যালেক্সের বাসায় মার্কিন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এফবিআই-এর লোকজন এসে অ্যালেক্সের সব চ্যাটের তথ্য ডাউনলোড করে নিরাপত্তার বিশ্লেষণের জন্য নিয়ে যায়। এরপর অ্যালেক্সের দাদীমা অ্যালেক্সকে নিয়ে ভ্যাকেশনে বের হন। বেশ কয়েক মাস সামাজিক মাধ্যম ছেড়ে সব কিছু থেকে দূরে ছিল অ্যালেক্স । ব্রেইন ওয়াশ হয়ে যাওয়া অ্যালেক্স আবারো  নিরাপদ জীবন যাপনে আবার অভ্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু এরপর একদিন হঠাৎ অ্যালেক্স স্কাইপে লগইন করে ভিন্ন একটি অ্যাকাউন্ট থেকে। এ অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল অ্যালেক্সের পরিবার। লগইন করার সঙ্গে সঙ্গে ফয়সাল সেখানে যোগাযোগ শুরু করে। এ ঘটনার কয়েক মাস পরেও তাদের মেসেজ যোগাযোগ করতে দেখা যায়। সে লেখে, ‘আমি আর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব না….. কিন্তু আমি মিথ্যা বলেছিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comment moderation is enabled. Your comment may take some time to appear.