আজ : ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Breaking News

পেয়ারার রাজ্য বরিশালের ৫৫ গ্রাম

এম জামাল হোসেন : পেয়ারা পাল্টে দিয়েছে বরিশাল বিভাগের তিন জেলার ৫৫ গ্রামের গ্রামচিত্র। এই এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ নিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ, জীবিকার অবলম্বন। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খাল জুড়ে শুধু ‘ধবল’ পেয়ারার সমারোহ। আষাঢ় পেরিয়ে ভাদ্রের এ সময় দূর দূরান্তের বেপারীদের আনাগোনায় পেয়ারা মোকামগুলিতে রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পেয়ারা বাগান সেই সাথে এই ফলের আস্বাদ নিতে বহু পর্যটকের এসব নদীপথে দেখা মেলে। পাকা পেয়ারার এক মদির গন্ধ চারিদিকে। ছোটো ছোটো নৌকা নিয়ে পেয়ারা চাষী, ব্যবসায়ী আড়তদার, পাইকারের ট্রলার, মালবাহী নৌকায় তুলে দেয়। কোথাও ঝুড়ি ভরে বাছাই করা পেয়ারা ট্রাকে তুলে দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে পেয়ারা এখানে মৌসুমী ফল, কৃষিজাত পণ্য শুধু নয় প্রধান ব্যবসার অবলম্বন। পেয়ারার মৌসুম ঘিরে তাই ‘নাইওর’ আসে কন্যারা। ‘পেয়ারা’ সবার কাছে নিয়ে আসে সাংবাৎসরিক উৎসব । পেয়ারার সাম্রাজ্য : বরিশাল বিভাগের অন্যত্র ছিটে ফোঁটা পেয়ারা হলেও বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, ঝালকাঠী জেলার ঝালকাঠী সদর ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠী ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বরিশাল জেলার বানারীপাড়ার ১৬ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠী জেলার ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে, স্বরূপকাঠীর ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠীর কীর্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠী, জগদীশপুর, মীরকাঠী, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠী, আদাকাঠী, রামপুর, শিমুলেশ্বর এই গ্রামে বৃহৎ অংশ জুড়ে বাণিজ্যিকভাবে যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ হয়। স্বরূপকাঠীর ২৬ গ্রামের মধ্যে রয়েছে সঙ্গীতকাঠী, খায়েরকাঠী, ভদ্রানন্দ, বাচ্চুকাঠী, ভাংগুরা, আদাবাড়ী, রাজাপুর, ব্রাহ্মণকাঠী, ধলহার, জিন্দাকাঠী, আটঘর, কুড়িয়ানা, পূর্ব জলাবাড়ি, ইদিলকাঠী, আরামকাঠী, মাদ্রা, গণপতিকাঠী, আতাকাঠী, জামুয়া, জৈলশার, সোহাগদল, আদমকাঠী, অশ্বত্থকাঠী, সমীত, সেহাংগল, আন্দারকুল। বরিশালের বানারীপাড়ার পেয়ারা বাগানগুলো হলো তেতলা, সৈয়দকাঠী, মালিকান্দা, ব্রাহ্মণবাড়ি, বোয়ালিয়া, জম্বুদ্বীপ, বিশারকান্দি, মরিচবুনিয়া, মুরার বাড়ি, উমরের পাড়, লবণ সড়া, ইন্দির হাওলা, নরেরকাঠী, রাজ্জাকপুর, হলতা, চুয়ারিপাড়। এসব গ্রামের কয়েক হাজার কর্মজীবী পরিবার যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ করছে। পেয়ারার চাষ, ব্যবসা ও বাজারজাতকরণেও রয়েছে কয়েক হাজার মৌসুমী বেপারী এবং শ্রমিক। এ সময় অন্তত কুড়িটি স্থানে পেয়ারা পণ্যের মৌসুমী মোকামের সৃষ্টি হয়। এগুলো হলো ভিমরুলী, আতাকাঠী, ডুমুরিয়া, গণপতিকাঠী, শতদশকাঠী, রাজাপুর, মাদ্রা, আদমকাঠী, জিন্দাকাঠী, বর্ণপতিকাঠী, আটঘর, কুড়িয়ানা, আন্দাকুল, রায়ের হাট, ব্রাহ্মণকাঠী, ধলহার, বাউকাঠী। এসব মোকামের মৌসুমে প্রতিদিন ৫/৭ হাজার মন পেয়ারা কেনাবেচা হয়ে থাকে।
পেয়ারার আদি ইতিহাস : ‘পেয়ারা’ কবে থেকে এই মাটিতে এই প্রশ্নে স্থানীয় মানুষরা জানান শত, শত বছর ধরেই তারা বংশানুক্রমে পেয়ারার চাষ করছেন। তাদের মতে আনুমানিক ২শ বছর আগে স্থানীয় কালীচরণ মজুমদার ভারতের ‘গয়া’ থেকে এই জাতের পেয়ারার বীজ এলাকায় রোপণ করেন। সেই থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে পেয়ারার চাষ। তবে প্রাচীন পেয়ারা চাষীরা জানালেন আগে বিচ্ছিন্ন আবাদ হলেও ১৯৪০ সাল থেকে শুরু হয়েছে পেয়োরার বাণিজ্যিক আবাদ। এই আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। ২০১০ সালে অন্তত ১৯৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক পেয়ারার আবাদ হয়েছে। এ সময় ফলন হয়েছে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিকটন পেয়ারা।
পেয়ারার চাষ : জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে ভাদ্রের শেষ এই তিন মাস পেয়ারার মওসুম। তবে ভরা মওসুম শ্রাবণ মাস জুড়ে। এরপর ক্রমশন কমতে থাকে পেয়ারার ফলন। চৈত্র বৈশাখের মধ্যেই পেয়ারা চাষীরা বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণত ছোট ছোট খাল/নাল দ্বারা বাগানগুলি মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। চাষীরা মৃতপ্রায় গাছের ডাল কেটে, মাটি আলগা করে পেয়ারা গাছে আলাদা করে যতœ নেয়। বাগানের চতুর্দিক জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নালা কেটে মাটি পেয়ারা গাছের গোড়ায় দেয়া হয়। চাষীরা জানান পেয়ারা গাছে তেমন কোন সার বা আলাদা করে কিছু দেবার প্রয়োজন নেই। শুধু পরিচর্যাই যথেষ্ট। সারাবছর তেমন কোন কিছু করার দরকার হয় না। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসেই পেয়ারা গাছে ফুল আসতে শুরু করে। তবে বৃষ্টি শুরু না হলে পেয়ারা পরিপক্ক হয় না। জমি ভালো হলে হেক্টর প্রতি ১২/১৪ মেট্রিক টন পেয়ারার উৎপাদন হয়।
সবুজ আপেল যায় বিদেশেও : পেয়ারা’ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম শুধু নয় বিমানে পাড়ি দিয়ে ব্রাজিল, পর্তুগীজ, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, মালয়েশিয়া সহ দূরান্তে যাচ্ছে। তবে স্থানীয়দের হাতে নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের গুটিকয়েক ব্যবসায়ীই এই লাভজনক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রায়ের হাটে পেয়ারার পাইকারী ব্যবসায়ী হারুন খান জানান- তিনি মোকাম থেকে সিজনে প্রতিদিন ৩/৪ মন পেয়ারা সিলেটে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে পাঠান। সেখান থেকে এই পেয়ারা যায় বিদেশে। শুধু রায়ের হাট নয় প্রতিটি মোকামেই বিদেশে পেয়ারা রপ্তানিকারকরদের এজেন্ট বাছাই করে পেয়ারা কিনে ঝুড়ি বা প্যাকিংজাত করে ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেটের বিমান বন্দরে পাঠিয়ে দেয়। বিদেশের বাজার শুধু নয় দেশীয় বাজারেও রসালো এই পেয়ারার চাহিদা অত্যাধিক। চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন সিজনে শত শত ট্রলার, নৌকা, ট্রাকে করে পেয়ারার চালান নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা।
ফলন কম, দুঃখ-দুঃখই : এ বছর পেয়ারার ফলন কম হয়েছে- এ তথ্য চাষী ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের। ফলন কম হওয়ায় পেয়ারা চাষী ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। পেয়ারার মুকুল আসার পর থেকে অনাবৃষ্টির কারণে মূকুল ঝড়ে যায়। জিন্দাকাঠীর পেয়ারা চাষী রনজিৎ কুমার ক্ষোভের সাথে সাংবাদিকদের জানান “ছবি দিয়া কি হইব? ছবি করলে গইয়াও লজ্জা পায়, বাঁচার পথ থাকলে হেইয়ার পদ্ধতি করেন।” স্থানীয় চাষীরা জানান, মৌসুমে পেয়ারার দাম পড়ে যায়। বাগানে অনেক সময় প্রতি মণ পেয়ারা ৪০ টাকা মন দরেও বিক্রি হয়। তখন দুঃখ কষ্টে পেয়ারার নৌকাও ডুবিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয়রা জানান কাপুড়কাঠী সুনীল মন্ডলের পেয়ারার বড় বাগান রয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ১০০ মন পেয়ারা তার হাটে ওঠে। দাম পড়ে যাওয়ায় ৪০ টাকা মন দরে পেয়ারা ৪০০০ টাকা বিক্রি হয়। ১০ জন পাড়াইয়া (পেয়ারা বাগান পরিচর্যাকারী) রোজ দিতে হয় ৪৫০০ টাকা, পরিবহন ব্যয় মিলে প্রায় প্রতিদিনই লোকসানের শিকার হয়। শুধু সুনীল মন্ডল নয়, সিজনের পাকা পেয়ারার ফলন নিয়ে বিপাকে গোটা পেয়ারা চাষীরা। সাধারণত ফল পাকলে গাছ থেকে ঝড়ে পড়ে। পেয়ারা সংরক্ষণের উপায় না থাকায় প্রতিদিন শত মন পেয়ারা পরে নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিবছর জুলাইয়ের শেস ১৫ দিন বাগানে পেয়ারার প্রতি মন প্রতি দর ৪০ থেকে ৬০ টাকায় নেমে যায়। সাধারণত দর ভালো থাকলে বাগানে পেয়ারার মন ১০০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। ভাদ্রের দিকে ফলন কমে গেলে ২৫০ টাকা পর্যন্ত এই দর ওঠে। তবে বাগান থেকে মোকামের মধ্যে পার্থক্য প্রচুর। আগস্টের প্রথম দিকে বাগানে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা দরে পেয়ারার মন হলেও মোকামে তা ২২০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা ২২০ থেকে ২৫০ টাকা দরে পেয়ারা কিনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা মন দরে শহরে খুচরা বিক্রি করে থাকে। বাগান থেকে ভোক্তা পর্যন্ত ৩ হাত ঘরে ১০ গুণ বেশী দামে পেয়ারা কিনে খেতে হয়।
এগ্রোবেইজড শিল্প না হওয়া, : পেয়ারার জেলী পৃথিবী বিখ্যাত। বরিশালের উৎপাদিত পেয়ারার এই পার্সেন্টিজ অত্যন্ত বেশী। তাই বিদেশে মূলত এই পেয়ারা জেলী তৈরীর কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি হয়ে থাকে। জেলী অত্যন্ত পুষ্টিকর ও দামী খাবার সত্বেও পেয়ারা ঘিরে এখন পর্যন্ত তেমন কোন এগ্রোবেইজড শিল্প গড়ে ওঠেনি। ফলে উৎপাদিত পেয়ারা সংরক্ষণের অভাবে চাষীরা মার খাচ্ছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিসিকের সহযোগিতা অথবা ব্যবসায়ীক উদ্যোগে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন না হওয়ায় পেয়ারাভর সিজনে দাম পায় না উৎপাদন কারীরা।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও উন্নত হয়নি ভাগ্য : এছাড়া পোয়ারা উৎপাদক অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থাও একটি বড় সমস্যা ছিলো। চারিদিকে নদী-খাল-নালা-জলাভূমি থাকায় নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। কিন্তু দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে পেয়ারা সরবরাহ করার মতো সড়ক পথ উন্নত হয়েছে। কিন্তু ট্রাক, মিনি ট্রাক, পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে সরবরাহ করা হচ্ছে পেয়ারা।
পেয়ারার অ্যানথ্রাকস রোগ : দক্ষিণাঞ্চলে সিডর তছনছ করে দিয়েছে তার কৃষি ও মৎস্য সম্পদ তথা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। কিন্তু বরিশালের পেয়ারা চাষীদের কাছে সিডর এসেছে আশীর্বাদ নিয়ে। পেয়ারা চাষী পূর্ব ব্রাহ্মণকাঠী গ্রামের বাসিন্দা ধীরেন্দ্র কৃষ্ণ মল্লিক জানালেন- সিডরের মত অ্যানথ্রাকস (ছিট রোগ) উধাও। এক সময়ে ছিট রোগের কারণে পেয়ারা ফলন কমে এসেছিল কিন্তু সিডরের পর কোথাও এই রোগ দেখা যায়নি। কিন্তু এবছর আবার পেয়ারায় এ্যানথ্রাক্স রোগ দেখা দিয়েছে। এ কারণে রোগাক্রান্ত পেয়ারা কিনতে চাচ্ছে না চাষীরা।
মুক্তিযুদ্ধে পেয়ারা বাগান :আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল অঞ্চলের স্বরূপকাঠী-ঝালকাঠী ও বানারীপাড়ার ৩৬ গ্রামের পেয়ারা বাগানের অবিস্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে এসব পেয়ারা বাগানে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাটি গড়ে তোলে ও বহু অপারেশন চালায়। এর মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় কুড়িয়ানার। অন্যান্য ঘাঁটিগুলো হল মাদ্রা, আতা, জিনুহার, ইদিলকাঠী, অশ্বত্থকাঠী, জামুয়া, ব্রাহ্মণকাঠী, বাউকাঠী, ভিমরুলী, জিন্দাকাঠী সহ বহু গ্রাম রয়েছে। ১৯৭১ সালে পেয়ারা বাগানের এই ৩৬ গ্রামে যাতায়াত বলতে ছিল একমাত্র নৌকা। দুর্গম যাতায়াতের কারণে এখানে বসে নিরাপদে থেকে অপারেশন চালানো সহজ ছিল। তৎকালীন সময়ে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা “সিরাজ সিকদার” ‘ছালাম ভাই’ নাম দিয়ে আশেপাশে বিশেষ করে বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠী, পিরোজপুর, ঝালকাঠিতে অপারেশন চালাতো। এছাড়া বেনীলাল দাশগুপ্ত ও ক্যাপ্টেন বেগের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ ২টিও সক্রিয় ছিল্। ক্যাপ্টেন বেগ কুড়িয়ানা হাইস্কুলে ক্যাম্প গড়ে তালেন- অস্ত্র প্রশিক্ষণও দিতেন। মনিকা, বিথী, শোভা, শিখা সহ মেয়েদের সশস্ত্র গ্রুপটিকে তিনি ও বেনীলাল দাশগুপ্ত অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে এখানে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর স্পীডবোটে গুলী করলে স্পীডবোটটি ডুবে যায়। বোটের চালককে হত্যা করা হয়। স্পীডবোটটি পটুয়াখালীর তৎকালীন সামরিক প্রধান নাদির পারভেজের ছিল। কুড়িয়ানার মুক্তিযোদ্ধাদের স্পীডবোট অপারেশনে আতঙ্কিত হয়ে পাকবাহিনী সে মাসে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ৩৬ গ্রামে হামলার প্রস্তুতি নেয়। পাকবাহিনী কুড়িয়ানা হাইস্কুলে ক্যাম্প গড়ে তোলে। এখানে পাকবাহিনী ২১ দিন অবস্থান করে। এই ২১ দিনে পেয়ারা বাগানকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। সে সময়ে ছারছিনা পীরের নির্দেশে নেছারাবাদ মাদ্রাসার ছাত্ররা ৩৬ গ্রামের পেয়ারা বাগান কেটে সাফ করে দেয়। মাদ্রাসার ছাত্র ছাড়াও পাকবাহিনীর হাতে ধৃত বন্দী মানুষদের পেয়ারা বাগান কাটার কাজে লাগিয়ে দেয়া হয়। কয়েক দিনের মধ্যে পেয়ারা বাগান কেটে সাফ করা হয়। পাকবাহিনী এই ২১ দিনের তিন দিনই স্পীড বোট নিয়ে একেকটি গ্রামে অংগিসংযোগ, হত্যা, লুণ্ঠনে মেতে উঠতো। ক্যাম্পে মেয়েদের ধরে এনে বীভৎস নির্যাতন চালাতো। প্রত্যক্ষদর্শী অনুপ বরণ চক্রবর্তী জানিয়েছেন কুড়িয়ানা ক্যাম্পে অসংখ্য মেয়েদের ধরে এনে নির্যাতন আমি স্বচক্ষে দেখেছি- মেয়েদের কান্না-চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসতো। পাকবাহিনী ২১ দিন এখানে অন্তত ৫/৭শ মেয়েদের ধর্ষণ করে। ক্যাম্পে থেকে প্রতিদিন ২০/২৫ জনকে শ্যামলাল শিকদারের জমির সংলগ্ন খালে ও কাছের ডোবায় গুলী করে ফেলে দিতো। স্বাধীনতার পর রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা এই ডোবা থেকে ১৭০ টি মাথার খুলি উদ্ধার করে। মুক্তিযুদ্ধে এই অঞ্চলের বহু মানুষের জীবন যায়। স্থানীয় মানুষ কারো কারো মতে এই সংখ্যা ৫০ হাজারের কম না। স্থানীয় অধিবাসীরাও জানিয়েছেন এখানে ৩৬ গ্রামের শত শত মানুষ শুধু নয় বাহির থেকে নিরাপদ মনে করে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার মানুষের একটি বড় অংশ হত্যার শিকার হয়েছেন। যাদের সম্পূর্ণ নাম পরিচয় পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব।
পেয়ারা শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা : মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩৬ গ্রামের পেয়ারার চাষ হলেও এই চাষ বর্তমানে ৫৫ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। কাগজে কলমে ২০/২২ হাজার মেট্রিকটন উৎপাদনের হিসাব থাকলেও হিসাবের বাইরে আরো কয়েক হাজার পেয়ারা উৎপাদন হয় বলে চাষী সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু অর্ধশতাধিক বছরের পুরোনো চাষ হলেও চাষী পর্যায়ে সংগঠিত রূপ না থাকায় মেলেনি কোন সরকারি সহায়তা। স্থানীয় পেয়ারা চাষী মুকুন্দ ঘরামী জানান- পেয়ারা চাষীরা চড়া সুদে এনজিওদের কাছ থেকে ঋণ নেয়। গত বছর থেকে কৃষি ব্যাংক সামান্য পরিমাণ ঋণ দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল সামান্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এ বছর পেয়ারা ও আমরা চাষী কল্যাণ সমিতি নামে একটি সমিতি গঠন করা হয়েছে। এই সমিতির মাধ্যমে ঋণ চাওয়া হলে ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিলেন অগ্রণী ব্যাংকের ডিজিএম তোফাজ্জেল হোসেন। তবে চাষী পর্যায়ে সংগঠন এখন কার্যক্রম শুরু করতে না পারায় এগোতে পারছে না। ২০১০ সালের শুরুতে তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর ড. আতিউর রহমান বরিশাল অঞ্চলে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিদর্শন করে বরিশালের এগ্রোবেইজড শিল্প বিশেষ করে পেয়ারা, আমরা ও নারিকেল জাত পণ্যের শিল্প গড়ে তুলতে বিনিয়োগকারীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে সকল ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও বিনিয়োগকারীরা এখানে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Comment moderation is enabled. Your comment may take some time to appear.